প্রিয়কাহন পর্ব ২

ছোটআম্মু জলদি আসো, প্রিয়তা অভী ভাইয়ার গায়ে গোবরসহ ময়লা পানি ফেলে দিয়েছে!’

রুদ্রর এ কথায় প্রিয়তার শরীরে যেন অনবরত কাপাকাপি শুরু হয়ে গিয়েছে। কি করলো এটা সে? মা দেখলে তো মেরেই ফেলবে তাকে। অভীর নিজেকে হাস্যপাত্র মনে হচ্ছে। হবু শ্বশুড়বাড়িতে আসতে না আসতেই গোবর পানি দিয়ে এত সুন্দরভাবে বরণ করবে জানলে কস্মিক কালেও এখানে পা বাড়াতো না। সে দেখলো বাগান থেকে ছুটে আসছে সায়রা বানু। কিছুক্ষণ বিস্ময়ে সে তাকিয়ে রইলো নিজের মেয়ে প্রিয়তা আর অভীর দিকে। হায় আল্লাহ! কি কান্ড করেছে এই মেয়ে? মানসম্মান সব ধুয়েই ছাড়বে এই গাধীটা। অভীকে দেখে সায়রা বানু কাদো কাদো সুরে বললো,

‘ আহা! বাবা এ কি অবস্থা হয়েছে তোমার? জলদি আসো। জলদি ভেতরে এসে পরিষ্কার হয়ে নাও। হাতে কি এটা?’

অভী আরও একবার দেখে নিলো হাতে থাকা বগুড়ার দই। নাহ! এটার সর্বনাশ হয়েছে। প্রিয়তা নামের গাধা মেয়েটা ওকে সহ বগুড়ার দইকেও গোবর পানি দিয়ে গোসল করিয়েছ। গা থেকে বিশ্রি গন্ধ বেরোচ্ছে এবার। সায়রা বানু কি করবে ভেবে পেলো না। রগচটা হয়ে তাকালো সে প্রিয়তার দিকে। বললো,

‘ চোখ কি আসমানে তুলে পানি ছুড়েছিস তুই? সামনে এত বড় ছেলেটাকে তুই দেখিসনি?’

প্রিয়তা কেঁপে উঠলো মায়ের ধমকে। তোতলাতে শুরু করলো। কথা গুলিয়ে যাচ্ছে। এ নতুন না। অভীকে দেখলে সবসময়ই তার কথা গুলায়। আগে যখন নুরুল স্যারের কাছে পড়তে যেত তখনও। শেষমেষ বলে ফেললো,

‘ আমার কি দোষ, আমি কি জানতাম এই লোক হনুমানের মতো এসে পড়বে?’

সাথে সাথে মুখ চেপে ধরলো প্রিয়তা। ফট করে যে অভীর সামনেই অভীকে হনুমান তুল্য করবে এটা খেয়াল করেনি। সায়রা বানু আরও খেপে গেলেন। অভীর সামনেই কান মলা দিলেন প্রিয়তার। বলে উঠলেন,

‘ পাজি মেয়ে। আর একটা উল্টাপাল্টা কিছু বলবি থাপড়িয়ে দাঁত ছুটিয়ে ফেলবো। জলদি অভীর হাত থেকে দইয়ের পাতিল নিয়ে চোখের সামনে থেকে দূর হ! আর রুদ্র, তুই অভীকে গোসল খানায় নিয়ে যা। আল্লাহ! কি অবস্থা করেছে সোনার ছেলেটার।’

অভী লজ্জায় পড়ে গিয়েছে। না পারছে সইতে না পারছে কিছু বলতে। বাড়িতে ঢোকা মাত্রই প্রিয়তার বোন অরিন, চাচী আর দাদি যেভাবে অভীর দিকে তাকিয়ে ছিলো যেন ছেলেটা কোনো ভিনগ্রহের প্রানী। অবশ্য এখন ভিনগ্রহেরই লাগছে। এ বাড়িতে আসবে বলে মা একটা ধবধবে সাদা শার্ট ইস্ত্রী করে দিয়েছিলো অভীকে। এখন সেটা গোবর রঙে রাঙায়িত। এই লজ্জায় নুন ছিটা দিতে এসে পড়লো অদ্রি। ঘুমুঘুমু চোখ মিয়ে সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে অভীকে দেখে চিৎকার করে বললো,

‘ ও আল্লাহ! রুদ্র অভী ভাইয়ার এ অবস্থা কেনো?’

অভী কোনোমতে নিজেকে সংবরণ করলো। ইচ্ছে করছে প্রিয়তাকেও গোবরে মাখামাখি করিয়ে রাখতে। এই মেয়ের সাথে বাবা যে কেন ওর বিয়ে দেওয়ার জন্য উতলা হয়ে গিয়েছে তা নিজেও জানেনা অভী। রুদ্র অভীকে নিয়ে এলো প্রিয়তার রুমে। পাশের রুম থেকে নিজের একটা ট্রাউজার দিয়ে বললো,

‘ আপনি এই রুমের ওয়াশরুমে ঢুকে একটা চনমনে গোসল দিন ভাইয়া। ইচ্ছে করেই প্রিয়তার রুমে আপনাকে নিয়ে এসেছি। ওর বাথরুমে শ্যাম্পু বডি ওয়াশ যা আছে সব শেষ করে দিন। গায়ে ঢেলে মনমতো গোসল করুন। বি ইজি। প্রিয়তা আপনার গায়ে গোবর পানি ফেলেছে। আপনারও উচিত ওর সব শ্যাম্পু সাবান শেষ করা। ইটস কলড রিভেন্জ টু রিভেন্জ।’

সুর টানতে টানতে প্রিয়তার রুম থেকে বেরিয়ে গেলো রুদ্র। অভী নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর গোসলের জন্য পা বাড়ালো বাথরুমের দিকে।

.
.

কপাল বেয়ে ঘাম ছুটছে প্রিয়তার। পরনে সুতি জামায় প্যাচপ্যাচে ভাব। চাচী রান্নাঘরে খুন্তি নিয়ে তীক্ষ্ণভাবে দেখে চলছে প্রিয়তাকে। পাশে সায়রা বানু সমানতালে বলে চলছে কি ঘটেছে একটু আগে। মাঝে মাঝে প্রিয়তার তো সায়রা বানুকে কুটনীবাজ মা মনে হয়। এই মহিলা কিছু পারুক আর না পারুক, নিজের পেটের সন্তানের বদনাম অন্যের কাছে বলতে পারদর্শী।
ইলিনা বেগম দম নিলো। বলে উঠলো,

‘ তুই কি জীবনে ঠিক হবি না রে প্রিয়তা?’

প্রিয়তা বলতে গেলেও কিছু বললো না। সে তো আর ইচ্ছে করে পানি ছুঁড়ে মারেনি। অদ্রি চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসে বড়ই খাচ্ছিলো। আচমকা বললো,

‘ এখন এটা বলবি না যে তুই ওই হাতি সাইজ মানুষটাকে দেখিসনি।’

প্রিয়তা মনে মনে অদ্রিকে গালাগাল দিলো। ভয়াবহ টাইপ গালাগাল দিলো। মেয়েটা জানে যে সে এখন ভয়াবহ অবস্থায় আছে তবে এসব কথাবার্তা বলে উত্তাল করছে কেন পরিবেশ। সব ছেড়ে যদি সন্ন্যাসবেশে পালিয়ে যেয়ে অভী নামক উৎপাত থেকে পালাতে পারতো তাইলে বেশ হতো। সায়রা বানু বললেন,

‘ এই৷দূর হ চোখের সামনে থেকে। অভীর কাছে রুদ্র আছে। ভুলেও ওর ধারেকাছে যাবি না। নাইলে কি ঘটিয়ে দিবি খোদাই জানে। ‘

সায়রা বানুর কথাটি বলতে দেরি, অদ্রিকে হাত টেনে দৌঁড়ে বাগানের দিকে চলে গেলো দু’জনে। বাগানে অরিন সহ ওদের বাকি ভাইবোনেরা আছে। বাকি দুজন হলো রুশি আর তুশি, দুজনেই ছোট ফুপির ছয় এবং আট বছরের মেয়ে। রুশি তুশির বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ওদের ফুপি এখানেই থাকছে। প্রিয়তা আর অদ্রিকে দেখা মাত্রই দুবোন হইহই করে ছুটে এলো তাদের কাছে।

অদ্রি গাল টেনে বললো,

‘ আমার ময়নাপাখিগণস! কি অবস্থা? কাচকলা ভর্তা খেয়েছিস!’

‘ হুম অদি আপু, ভীষন ইয়াম্মি। প্রিয়তা আপুর বিয়ে হলে দাদিকে বলবো, পোলাও মাংস না দিয়ে সবাইকে কাচকলা ভর্তা খাওয়াতে।’

হেসে দিলো প্রিয়তা। এই দুজনেই ভীষণ মজার কথা বলে। তুশির মুখ ভার। অদ্রি জিজ্ঞেস করলো,।

‘ তোর আবার কি হলো?’

‘ রুশি আমার ভাগ লুটেপুটে খেয়েছে অদি আপু। তুমি ওরে মাইর দাও।’

অদ্রি বিচক্ষণের মতো ভাবলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো,

‘ শোন পিচ্চি, কোনো ঝামেলা হলে বড়দের বলবি না, ডিরেক্ট ধুমধাম লাগিয়ে দিবি। একবার কি হয়েছে শোন৷ তোর রুদ্র ভাইয়া আর আমি একবার গাছে উঠেছিলাম আম পাড়তে। শালায় আমার হাতে থেকে আম টেনে সিঙ্গারা বানিয়ে খেয়েছে। ‘

তুশি রুশি আগ্রহ নিয়ে তাকালো অদ্রির দিকে৷ বললো,

‘ তারপর কিছু বলোনি ভাইয়াকে?’

‘ তুই কি আমায় প্রিয়তা পেয়েছিস যে কিছু হলেই ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতাম? আমি পাল্টা মেরেছি ওকে। পাছায় এমন এক লাত্থি দিয়েছি যে ব্যাটায় ফট করে গাছ থেকে পড়ে গেছে। চৌদ্দ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলো৷ একমাস, বিছানায় চিৎ হয়ে শুতে পারেনি।’

খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো তুশি রুশি। প্রিয়তা রাগে কটমট করে বললো,

‘ কি শিখাচ্ছিস ওদের?’

‘ তুই এখানে নজর দিস না মামা? তুই তোর পেয়ারের বরের কাছে যা। ‘

‘ কি যা তা বলছিস? আমি অভী ভাইয়াকে বিয়ে করবো না।’

‘ তুই যা আকাম শুরু করেছিস সে নিজেও তোরে বিয়ে করবো না। সো টেনশন মুক্ত থাক। তবে ভেবে দেখিস জানু। পোলায় হট আছে। আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই সিনিয়র স্টুডেন্ট অভী ভাইয়া। আমাদের ব্যাচসহ সব ব্যাচেই তার নামডাক৷ তার ওপর তোর কলেজের স্যারের বড় ছেলে। এমন ছেলেরে কেমনে রিজেক্ট করতে চাস তুই?’

‘ তুই জানিসনা কেন?’

‘ হইসে, আর বলতে লাগবো না। এখন যা উপরে যা। আমি এখন ভর্তা খাবো।’

পা চালিয়ে উপরে গেলো প্রিয়তা। অভী মনে হয় রুদ্রর রুমে গোসল করছে। রুদ্ররও আশপাশে কোনো খবর নেই। প্রিয়তা দ্রুত জামা পাল্টানোর জন্য নিজের ঘরে গেলো। শরীরে ঘাম জবজব করছে উত্তেজনায়। প্রতিবারই অভীর সামনে কিছু না কিছু কান্ড করেছে সে। এগুলো করা যাবে না। কাল ভার্সিটির ক্যাম্পাসে অভীকে পেলে সে ঠান্ডা মাথায় বুঝাবে যে সে বিয়ে করবে না। এখন এই জলসা বাড়িতে না বলাটাই শ্রেয়৷ প্রিয়তা মায়ের ভয়ে ড্রয়ার থেকে একটা পাতলা সুতির শাড়ি হাতে নিলো। পর্দা টেনে দিলো ঘরের। সকালে চনমনে রোদ উঠলেও ঘরে এখন আলো আধারীর নিবাস। প্রিয়তা নিজের জামার চেনে হাত দিলো। সেটা টেনে নিচে নামাতেই হঠাৎ পেছন থেকে কাঁপা কাঁপা সুরে ভেসে এলো এক পুরুষালি কন্ঠস্বর,

‘ প-প্র-প্রিয়তা?’

হাত থেমে গেলো প্রিয়তার। নাহ! ভুল শুনেছে। এ অভী হতে পারে না। মোটেও অভী হতে পারে না। অভী হলে লজ্জায় আরও একদফা অজ্ঞান হয়ে যাবে সে। আল্লাহ! তুমি মেয়েটাকে সজ্ঞানে থাকার শক্তি দাও।

চলবে..

 

প্রিয়কাহন পর্ব ২ পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top