‘এই জানু! অভী ভাইয়া তোকে দেখে এমন ঘামছে কেনো? সেন্সলেস টেন্সলেস হয়ে যাবে নাকি?’
অদ্রির কন্ঠে উদ্রেক। প্রিয়তা নাস্তানাবুদ হয়ে তাকালো অভীর দিকে। আসলেই সে ঘামছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ফোটার নিষ্ক্রিয় আনাগোনা৷ প্রিয়তা অভীর এমন মনোভাব তো বুঝতেই পারলো না উল্টো আগ্রাসী হয়ে বললো,
‘ একি! আপনি ঠিকাছেন?’
অভী দৃষ্টি ফেরালো প্রিয়তার থেকে। জ্বরে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। খুবই খারাপ। মেয়েটাকে নিয়ে ভয়ংকর সব চিন্তাভাবনা পাখির বাসা করে রেখেছে। এসব চিন্তাভাবনা দূরে সরাতে হবে। অন্তু অভীর শরীরে হাত দিয়ে বললো,
‘ কি রে ব্যাটা তোর আবার কি হলো? জ্বর ঢাকার রাস্তার জ্যামের মতো বেড়ে গেলো নাকি?’
অভী ঢোক গিললো। প্রিয়তার হুট করে কি হলো নিজেও জানেনা। চুপচাপ টেবিল থেকে পানি নিয়ে অভীকে দিয়ে নরম কন্ঠে বললো,
‘ পানি খেয়ে নিন।’
অভী নিলো। আড়চোখে দেখে নিলো প্রিয়তাকে। কাঠবাদাম রঙের গোলাকার জামায় মায়াবী প্রিয়তাকে গোলগাল রাখছে। গালগুলো হয়ে আছে কাশ্মীরী আপেলের মতো। অভীর বুক আবারও দ্রিম দ্রিম করে কেঁপে উঠলো। হাতিয়ে নিলো গ্লাস। ঢকঢক করে পানি গিললো।
প্রিয়তা দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে। ওর অবচেতন মন ভালো করেই জানে জ্বরেই ছেলেটার এ অবস্থা। কুনাল বললো,
‘ ভাই আপনি কষ্ট করে এখানে বসে আছেন কেন বলুন তো? দেখেই বোঝা যাচ্ছে কুপোকাত অবস্থা। রুমে যান, রেস্ট নিন। আপনার ওষুধ পত্র যা লাগবে সব আমরা সাপ্লাই করবো। ‘
অন্তু একপ্রকার ঠেলেই অভীকে নিয়ে ওর বেডরুমে গেলো। প্রিয়তা নাকোচ করছিলো অভীর রুমে যেতে তবে রাইতাও ঠেলে নিয়ে গেলো প্রিয়তাকে।
অদ্রি তাল মিলিয়ে বললো,
‘ আরে লজ্জা পাচ্ছিস কেন জানু? হবু বরের রুমই তো? ক’দিন পর এইখানেই তোরা একসাথে থাকবি- রোম্যান্স করবি, আমারে খালামনির ডাক শোনাবি৷ চিল বেইব! মোটেও প্যারা নিবি না।’
প্রিয়তার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ এই ইবলিসটার মুখ থামা!’
অভীর রুম বাড়ির দক্ষিণ দিকে। জানালা খুলে দিলে হু হু করে বাতাস বয়। একদিকে বইয়ে ঠাসা টেবিল আর তারই পাশে একটা ড্রেসিং টেবিল। কয়েকটা ক্রিকেট ব্যাটও আছে। হয়তো ছুটির দিন দু ভাই মিলে খেলে। সবাই অভীকে রীতিমতো নাস্তানাবুদ বানিয়ে ফেললো। অন্তু এসে দিয়ে গেলো বস্তাভরা উপদেশ। অভী সবই শুনলো চুপচাপ করে। রাইতা পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে অন্তুকে দিয়ে বললো,
‘ এই খাবি?’
‘ তোরে কিন্তু ঠাসিয়ে চড় লাগাবো? এটা কি সিগারেট খাওয়ার জায়গা? আর তুই না মেয়েমানুষ! এসব সিগারেট খেতে লজ্জা করে না?’
রাইতার মুখের ভঙ্গি পাল্টালো না। বললো,
‘ কেন সিগারেটের প্যাকেটে কি লিখা আছে- ‘ধূমপান রমনীদের স্বাস্থ্যের জন্য নিষিদ্ধ?’ যেদিন এটা লিখা থাকবে সেদিন সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিবো!’
রাইতা চাঁদপুরের মেয়ে। প্রাণবন্ত হয়ে উঠাই তার সহজাত অভ্যাস। থাকছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে।এই মেয়েটা কিভাবে অন্তু, অভীদের বন্ধু হয়ে গেলো তা আরও ওদের কাছে বিস্ময়। রাইতা যখন সিগারেট ধরায় দুজনেই সরে দাঁড়ায় ওর কাছ থেকে। রাইতা তা দেখে হাসলেও কিছু বলে না। তবুও ওকে কখনও ছাড়তে পারেনি কেউ। প্রিয়তা চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো এতক্ষণ। হঠাৎ অভীর তাকানোতে সে আড়ষ্ট হলো। খেয়াল করলো সেই বিবর্ণ মুখের ঘোরমিশ্রিত দৃষ্টি। অন্তু তা দেখে হেসে হাত উচিয়ে বললো,
‘ এটেনশন গাইস! সেলিম আনারকলিকে দুমিনট টাইম স্পেন্ড করতে দেই। আমরা নিচে গিয়ে দেখি নাহয় কাকিমা কি নাস্তা টাস্তা দিচ্ছে।’
সবাই চলে গেলো অন্তুর পিছু পিছু। প্রিয়তা যেতে চাইলেও পারলো না। অদ্রি দুষ্টু হেসে বললো,
‘ সুযোগের সদব্যবহার করবি প্রিয়ু। টুপ করে তাকে জড়িয়ে ধরে দু’চারটা অশ্লীল বাক্য ছুড়বি।’
এই কথাগুলো শোনার পর প্রিয়তা যেন আরও অপ্রতিভ হয়ে পড়লো। একটুও নড়তে পারলো না দরজার পাশে দেয়ালের অবস্থান থেকে। অভী বিছানায় শুয়ে আছে আধশোয়া অবস্থায়। গায়ে পাতলা কাথা। তার ওপর রোদ পড়ছে আবছা। অভী বলে উঠলো,
‘ তুমি হুট করে আসলে যে?’
প্রিয়তা নাস্তানাবুদ হলো। বলতে আড়ষ্ট হলো যে সে অভীকে দেখতে এসেছে। রাগও হলো অভীর প্রতি। অভী জানে তার এখানে আসার কারন। তবুও মুখে হাসি চেপে শুনতে চাচ্ছে। বললো,
‘ জানেন না কেনো এসেছি?’
‘ না তো?’
প্রিয়তা বলে উঠলো,
‘ এই বাসায় একটা দামড়া ছেলে জ্বরে কুপোকাত হয়ে আছে। তাকেই দেখতে এসেছি।’
‘ মিস করছিলে আমায়?’
অভীর ঠোঁটে টানাহাসি। মাথা ঝাঁকালো প্রিয়তা। বললো,
‘ মোটেও না।’
অভী দুর্বল হাসি হাসলো। ইশারায় বললো,
‘ টুল আছে এখানে। বসো। আমি বাঘ ভাল্লুক না যে কাছে আসার পরই তোমায় টুপ করে খেয়ে ফেলবো।’
প্রিয়তা নতমুখে বসে পড়লো অভীর পাশে রাখা টুলে। দ্বিপ্রহর। থমকে আছে সময়। কথা খুঁজে পাচ্ছে না। অভী বললো,
‘ তিনদিন পার হয়ে গিয়েছে খেয়াল আছে?’
প্রিয়তা জানে। গতকালই তিনদিন পার হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু বাঁধ সেজেছিলো অভীর জ্বর। প্রিয়তা মৌন রইলো।সেই সন্ধ্যায় অভীর সাথে কাটানো সেই বৃষ্টিস্নাত মুহূর্তের কথা মনে আসতেই অজানা অনুভূতি হলো। অভীর দিকে তাকালো সে। এই জ্বরেও অন্যরকম একটা নেশাজড়ানো দৃষ্টি। প্রিয়তা বললো,
‘ আচ্ছা আপনি কি আমায় বিয়ে করতে চান?’
অভী চুপ রইলো কিছুক্ষণ। অতঃপর বললো,
‘ যতটুকু জানি আমার চাওয়া পাওয়া তোমার না জানলেও চলবে প্রিয়তা। তুমি কি চাও?’
‘ সময় চাই।’
প্রিয়তার এ কথায় হঠাৎ রাগ হলো অভীর। আর কত সময় চাইছে এই মেয়ে। এত স্পেস দেওয়ার পরও ভালোলাগছে না। পরন্তু ভাবলো, হয়তো প্রিয়তা নিজের জায়গাতেই ঠিক। উঠে বসলো অভী। ওর সাথে কথা বলতে ভালোলাগলো না। বললো,
‘ নিচে চলো।
————
শান্তনু ফিরে এসেছে ইস্কুল থেকে। জামা কাপড় না পাল্টেই অন্তুর সাথে আলুর পরোটা খেতে বলেছে। শান্তনু নাদুস নুদুস ছেলে। একে দেখলে মনেই হয়না যে এ অভীর আপন ভাই। সেলিনা কান টেনে বললেন,
‘ জামা কাপড় তো পাল্টে নিবি বেয়ারা ছেলে? এসেই খেতে বসেছে।’
শান্তনু পাত্তা দিলো না। অন্তুকে বললো,
‘ তোমার পিস টাও আমায় দিও তো ভাইয়া।’
প্রিয়তা নামলো অভীর পিছু পিছু। শান্তনু তাকে দেখামাত্রই ছুটে চলে গেলো। বললো,
‘ কেমন আছো বউমণি?’
প্রিয়তা হাসলো। বললো,
‘ এইতো ভালো। তুমি কেমন আছো? পড়ালেখা ঠিক আছে তো?’
‘ আরে বলোনা। অংকে ডাবল জিরো পেয়েছি। একটু সুযোগ পেলে বাবার সিগনেচার কপি করে দিও তো। নাইলে বাবা গুদামঘরে ঘুমাতে পাঠাবে। যেই মশা রে ওখানে বউমণি। শরীর ফুটে লাল হয়ে যায়।’
প্রিয়তা হেসে দিলো সেভেনে পড়া শান্তনুর কথায়। তাকে নিয়ে সোফায় বসলো। অভী বসলো রুদ্রের সাথে। আড়চোখে দেখে নিলো প্রিয়তাকে। প্রিয়তা নিজের পরোটার পিস চুপচাপে খাইয়ে দিলো শান্তনুকে। এ নতুন না। কলেজে পড়াকালীন সময় প্রিয়তা প্রায়ই টুকটাক ওর জন্য নিয়ে আসতো। তাই প্রিয়তাকে শান্তনুর এতো পছন্দের।
অভী হঠাৎ মনে ভয়াবহ এক কল্পনা সেরে ফেললো। সে অনুভব করলো প্রিয়তাকে নিজের প্রাণোসী হিসেবে। লাল শাড়ি, সাদা পাড়, খোলা চুলে তাকে লাগছে মায়াবীনি। মেয়েটা নিজের আদুরে দেবরকে নিঃশব্দে খাইয়ে দিচ্ছে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো অভীর। এসব জ্বরের কুলক্ষণ। প্রিয়তার এখানে আসা উচিত হয়নি। মোটেই উচিত হয়নি।
হঠাৎ প্রিয়তা প্লেট নিয়ে অভীর দিকে দিলো। বললো,
‘ খেয়ে নিন।’
অভীর শরীর কাপছে। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরতে। তবে সেটা সম্ভব না। গহীনে রাগও জমেছে প্রিয়তার প্রতি। কেননা প্রিয়তা তাকে অপছন্দ করে। কাঠ হলো সে। কঠোর গলায় বললো,
‘ খাবো না প্রিয়তা। রেখে দাও।’
‘ কিন্তু!’
‘ বললাম তো খাবে না! এভাবে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থেকে খামোখাই নিজের এনার্জি ওয়েস্ট করছো। দেখতে এসেছো, দেখে চলে যাও।’
অভী যে প্রিয়তাকে এভাবে কিছু বলবে সেটা আশানুরূপ ছিলো না প্রিয়তার। হঠাৎ সবকিছু নীরব, নিস্তেজ হয়ে গেলো। সেলিনা ধমকানোর সুরে বললেন,
‘ ওর সাথে কিভাবে কথা বলছিস তুই?’
প্রিয়তার বুক মোচড় দিয়ে উঠলো এমন কথায়। দেখলো রাইতা, অন্তু, আকিব, কুনাল সবাই অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অভিমানে কোণঠাসা হয়ে উঠলো প্রিয়তার মন। চুপচাপ প্লেটটা টেবিলে রেখে অদ্রি রুদ্রের পাশে বসলো। অভী কোনো কথা বললো না। শুধু মায়ের দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললো,
‘ মা আমি রুমে গেলাম। ‘
চলে গেলো অভী। প্রিয়তা নিশ্চুপে বসে রইলো এককোনায়। সেলিনা এসে বললেন,
‘ ওর কথায় কিছু মনে করো না মা। তুমি তো জানোই অভী কেমন ছেলে। কিন্তু ওর শরীর খারাপ থাকলে মাঝে মাঝেই এমন করে। এসব মনে রেখে দিও না কেমন। যদি পরে এটা টের পায়, অবশ্যই অনুতপ্ত হবে।’
যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। প্রিয়তা নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো। মুখ ভার। মনে জমেছে তীব্র ক্ষোভ। অভীকে একবার ভালোলাগলে আরেকবার ঘৃণা করতে ইচ্ছে করে। অথচ জমে ওঠে অভিমান। কিন্তু অভিমান নাকি ভালোবাসার মানুষদের জন্য হয়? কেন সে এভাবে চড়া গলায় কথা বললো প্রিয়তার সাথে। প্রিয়তার চোখে অশ্রু ভীড় করলেও তা সরিয়ে ফেললো। মনে মনে বললো,
‘ আপনি খুবই ইগোস্টিক অভী। খুবই খারাপ মানুষ। একজন মেয়ের সাথে কথা বলার সেন্সটুকু আপনার নেই।’
প্রিয়তা ধাতস্থ করলো সে আর অভীকে পরোয়া করবে না। লাগবে না এমন অভীকে যে তাকে সম্মান দেয় না। এমনকি অভী সরি বললেও না। কিন্তু কে জানত একদিন এই অভীর কাছেই সরি ছাড়া অপ্রত্যাশিত কিছু পেয়ে যাবে?
.
.
.
.
.
.
.
#চলবে