“ঠোঁটে চুমু খেলে কি পাপ হয় পরাণ ভাই? তুসির কথায় পরান রক্তিম চোখে তুসির দিকে দৃষ্টিপাত করল। রাগান্বিত হয়ে বলল,
“তোকে এসব কথা শেখায় কে?
“আমাকে শেখানো লাগে না। তোমার ঠোঁট দেখলেই আমার ভেতর থেকে কথা গুলো চলে আসে।
“তোর মতো অসভ্য আর নির্লজ্জ মেয়ে দু’টো দেখিনি।
“সে আমি অসভ্য হই আর ভালো হই। আমি তো তোমারই তাইনা বলো। এখন বলো ঠোঁটে চুমু খেলে পাপ হয় নাকি?
“হ্যাঁ হয়।
“তাহলে আজ থেকে আমি তোমার মতো সিগারেট খাব। তাহলে আমার আর পাপ হবে না। তোমার ঠোঁটে চুমু খাওয়ার নেশা টাও আমার কে’টে যাবে।
“তোকে কেন আমি আমার ঠোঁটে চুমু খেতে দিব৷ তোকে ধরতে গেলেই পালিয়ে যাস।
“এবার আর পালাব না। একবার দিয়েই দেখো। তুসির কথায় পরাণ তুসিকে ধরতে যাবে। তখনই তুসি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। পরাণের মুখশ্রী বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। পুরো ঘরটা পর্যবেক্ষণ করল। ঘরের কোথাও তুসি নেই। মুহুর্তের মধ্যে পরাণের মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। বুকের মধ্যে হাহাকারের মিছিল শুরু হলো।
আজ তিন মাস হয়ে গেল পরাণ তুসির কোনো খোঁজ পায়নি। রেহনাকে বলেও একটা শব্দ মুখ দিয়ে বের করেনি। কারো জীবন থেমে থাকেনি সবাই আগের মতো জীবন যাপন করতে ব্যস্ত। কিন্তু থেমে গিয়েছে একটি মানুষ হৃদয় সেটা হলো পরাণ। এখন সে রোজ নিয়ম করে তিন বেলা সিগারেট খায়। মাঝেমধ্যে মদ্যপান করতেও দ্বিধাবোধ করে না। তুসির পছন্দের ঠোঁটটা ধীরে ধীরে সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলছে। তুসি তার দেওয়া কথা রাখেনি। পরাণও তার শখের জীবন পুড়াইতে পুড়াইতে ছাই করে দিবে। ছেলের অধঃপতন দেখে মাহবুব রেহেনাকে বুঝিয়েছে। তবুও রেহেনার মন গলেনি। তার এক কথা নিজের বাড়ির আশ্রিতা মেয়েকে সে কিছুতেই বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নিবে না। পরাণ কেমন জানি শান্ত হয়ে গিয়েছে। আগের মতো পাগলামি করে না। সারাদিন চুপচাপ থাকে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। একদম জীবিত লাশের মতো। তাকে দেখে যে কারো অন্তর আত্মা কেঁপে উঠবে।
রায়ার শখের ফুলদানিটা তুসির হাত থেকে ভেঙে পড়ে গেল। তা দেখে ভয়ে তুসির শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগলো। তখনই রিয়া দৌড়ে এসে তুসিকে সরিয়ে দিয়ে নিজে তুসির জায়গায় দাঁড়াল। তবুও তুসির শেষ রক্ষা হলো না রায়া এসে তুসির চুলের মুঠি ধরলো। তুসি ব্যথায় কুঁকড়িয়ে উঠল। রিয়া রাগান্বিত হয়ে বলল,
“তুমি ওকে মারছ কেন আপু? তুসির কোনো দোষ নেই। আমি তোমার ফুলদানিটা ভেঙেছি মারতে হলে তুমি আমাকে মারো। আমার ভুলের শাস্তি কেন তুমি তুসিকে দিবে!
“তুই কবে থেকে তুসির চামচা হয়ে গেলি রে। আগে তো তুসিকে দুই চক্ষে সহ্য করতে পারতি না। ইদানিং তুসির প্রতি তোর দরদ উথলে পড়ছে তাই না রে। তোর কি মনে হয় আমি দেখেনি ফুলদানিটা তুসি ভেঙেছে। তুসির হয়ে সাফাই গাইতে এসেছিস। আজকে এই মেয়েকে আমি মে’রে’ই ফেলব। সামান্য কাজের লোক হয়ে নিজেকে কি মনে করে ও! আমার শখের ফুলদানিটা ভেঙে ফেলল এত বড় সাহস! রায়ার কথায় তুসির ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসতে শুরু করল। সে যতই ভুল করতে কম চায়। ভুলগুলো ততই তার সামনে এসে হাজির হয়। কালকের মারের ব্যথাটা এখনো শরীর থেকে যায়নি। আজকে মার খেলে নির্ঘাত সে মারা যাবে। তুসি কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
“আমি ইচ্ছে করে আপনার ফুলদানি ফেলিনি আপু। ঘর মুছতে গিয়ে কিভাবে যে হাত লেগে পড়ে গেল। সেটা আমি বুঝতে পারিনি। এবারের মতো আমাকে মাফ করে দিন। আমি এর পর থেকে আরো সর্তক হয়ে কাজ করব। তখনই রেনু এসে তুসির গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। রেনুকে দেখে রায়া আরো হিংস্র হয়ে উঠল। বজ্র কণ্ঠে বলল,
“একটা দিলে কেন মা আরো কয়টা লাগিয়ে দাও। অসভ্য মেয়ে একে তো ফুলদানি ভেঙেছে আবার বড় বড় কথা বলছে।
“আমার ভুল হয়ে গেছে বড় মা। আমি আর এমন ভুল জীবনেও করব না। আল্লাহর দোহাই লাগে আজকে আমাকে মারবেন না। আজ আমাকে মারলে আমি মরেই যাব। তুসির কথা শেষ হবার সাথে সাথে রুহি এসে তুসির হাত ধরে টানতে টানতে ওয়াশরুমে নিয়ে গেল। সেখানে ঝরনা ছেড়ে দিয়ে বলল,
“তুই আমাদের মারতে নিষেধ করেছিস। আমরা তোকে মারব না। টানা দুই ঘন্টা এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি। গলা দিয়ে একটা আওয়াজ বের হলে, আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। কথা গুলো বলেই রুহি দরজা লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল। তুসি চিৎকার দিয়ে বলল,
“আমাকে ছেড়ে দাও। আমার পরাণ ভাই আসলে তোমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। একজন কেও বাঁচতে দিবে না। আমার পরাণ ভাই কিছুতেই তার তুসির কষ্ট সহ্য করবে না। তোমরা ভাবতেও পারছ না পরাণ ভাই সবকিছু জানলে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হবে। রায়া তাচ্ছিল্য করে বলল,
“এই যে পরাণ ভাই পরাণ ভাই করে জীবন দিচ্ছিস। এই ছয় মাসে পরাণ কেন কোনো টরাণ ভাইও তোর খোঁজ নিতে আসেনি। এতটাই ভালোবাসে তোকে তোর পরাণ ভাই। তুসি কান্নায় ভেঙে পড়লো। সত্যি তো তার পরাণ ভাই কি তাকে ভালোবাসে না। তাকে যদি ভালোই বাসতো তাহলে তার খোঁজ এতদিন কেন নিল না? তার মামনি কি তার পরাণ ভাইকে সবকিছু বলে দিয়েছে। তার পরাণ ভাই নিশ্চই তাকে ঘৃণা করছে। না না তার পরাণ ভাই তাকে ঘৃণা করতেই পারে না। তুসি চিৎকার দিয়ে বলল,
“পরাণ ভাই ঠিক আসবে দেখো। এসে তোমাদের থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে।
“তোর পরাণ ভাই আসলেই বুঝি আমরা দিয়ে দিব। তোকে দুই লক্ষ টাকা দিয়ে কিনেছি। আগে আমাদের দুই লক্ষ টাকা উসুল হবে। তারপর তোকে যেতে দিব এর আগে এক পা-ও নড়তে দিব না।
“আমি জন্যই তোমাদের বাসায় টিকে আছি। তোমরা যে অমানুষ তোমাদের বাসায় কোনো কাজের মেয়ে টিকবে না। তুসির কথায় জ্বলে উঠল রায়া। তুসিকে মারার জন্য এগিয়ে আসতেই রিয়া রায়ার হাত ধরল,
“একটা শাস্তি মেয়েটা ভোগ করছে। একবারেই মেরে ফেলবে নাকি। তুসি তো ঠিকি বলেছে। আমাদের ব্যবহারের জন্য কোনো কাজের লোক আমাদের বাসায় টিকে না। তুসির মামনিকে টাকার লোভ দেখিয়ে তুসিকে নিয়ে আসতে পারছ। এত অত্যাচার করছ ওর মামনি টাকা নিয়ে এসে যদি বলে, এই নাও তোমাদের টাকা আমার মেয়েকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। তখন কাজের লোক কোথায় পাবে? তাই বলছি যা করবে সীমার মধ্যে থেকে করবে। সীম লঙ্ঘন করো না দেখবে মশাও বাঘে পরিনত হয়ে যাবে। রিয়ার কথায় দমে যায় রায়া। রুহি ও রায়া অবাক নয়নে রিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের ছোট বোনটা এতটা তুসি ভক্ত হয়ে গেল কিভাবে? সেটা দু’জনের মাথায় আসছে না! দু’জন রাগে হনহন করে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
পরাণ বিছানায় শুয়ে তৃতীয় নাম্বার সিগারেটটা ধরালো। ভেতরটা পুড়তে পুড়তে কয়লা হয়ে যাচ্ছে। তবুও প্রিয় মানুষ কে খুঁজে পাচ্ছে না। মৃত মানুষ মরে গেলে সেই শোক সামলিয়ে উঠা যায়৷ কিন্তু জীবিত মানুষ হারিয়ে গেলে সেই শোক কিভাবে সামলাবে পরাণ। দু-চোখ বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। ফোন হাতে নিতে তুসির হাসোজ্জল মুখশ্রী ভেসে উঠল। ভেতরের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। না পাওয়ার শূন্যতায় ভেতরটা দম বন্ধ হয়ে মারা যেতে চাইছে। বেঁচে থাকতে কি তুসির দেখা পাবে না সে৷ কথা গুলো ভাবতেই বুকটা ভারি হয়ে আসলো পরাণের।
চলবে…..