বিদেশ থেকে দশ বছর পর বাড়ি আসলো পরাণ। গৃহে প্রবেশ করতেই হৃদয়স্পন্দনের গতিবেগ তড়িৎ গতিতে ছুটে চলেছে। কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখার জন্য ভেতরটা উথাল-পাতাল শুরু করে দিয়েছে। পরাণের আঁখিযুগলে শুধুই তাকে দেখার তৃষ্ণা জেগেছে। মানুষটা কি জানে না পরান তাকে দেখার জন্য কতটা ছটফট করছে। মানুষটা তাকে কেন যে তাকে এতটা পোড়ায়? সে ধরনীর সব ব্যথা সহ্য করতে পারলেও, তার দেওয়া ব্যথা সহ্য করতে পারে না। ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়৷ রেহেনা ছেলেকে দেখে দৌড়ে এসে আলিঙ্গন করলেন৷ সমস্ত মুখশ্রীতে আদরে আদরে ভরিয়ে তুললেন।
“কেমন আছ মা? সবাইকে দেখছি তুসিকে দেখছি না। তুসি কোথায়? পা’জি’টা সারাক্ষণ আমাকে জ্বালিয়েছে। এখন কোথায় লুকিয়ে আছে। পরাণের কথায় রেহেনা আঁড়চোখে বিনুর দিকে তাকাল। বিনু মস্তক নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিনুর হাতেই তুসির ফোন৷ পরাণ আকুল হয়ে এদিক-সেদিক দৃষ্টিপাত করছে। তবুও নির্দিষ্ট মানুষ টার দেখা মিলছে না৷ সে রেহেনার উত্তরের অপেক্ষা না করে বাড়ির প্রতিটি ঘরে তুসিকে খুঁজল। কিন্তু তুসিকে কোথাও খুঁজে পেল না। ভেতরটা শূন্য হয়ে আসতে শুরু করল। তুসির ঘরের সামনে আসতেই বুকটা কেঁপে উঠল। তুসির ঘরের দরজায় তালা দেওয়া। আশেপাশে ময়লা জমে গিয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কয়েক মাস হলো এখানে কেউ থাকে না। পরাণের সবকিছু কেমন জানি শূন্য লাগছে। সে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো। কাল রাতেও তো বলল,
“পরাণ ভাই তাড়াতাড়ি দেশে আসো। তোমার ঠোঁটে চুমু খাব। অজানা হাহাকারে ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। তার খালি মনে হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটা সে হারিয়ে ফেলছে। মনের মধ্যে ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে৷ সে বিধ্বস্ত অবস্থায় খাবার ঘরে এল। শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল,
“তুসি কোথায় মা?
“এতদিন পর দেশে আসলি। বাবা-মায়ের খোঁজ তো একবারও নিলি না। এসেই তুসি তুসি করে পাগল হয়ে গেছিস। ঐ অপয়া মেয়ে আমাদের খেয়ে আমাদের পড়ে আমাদেরকে না জানিয়েই বাড়ি ছেড়েছে। সে কোথায় আমি কিভাবে বলব। তোর সাথে তার এত মিল সে তোকে জানায়নি। সে আমাদের বাড়িতে আর থাকে না। মস্তকের ওপরের বিশাল আকাশটা পরানের মস্তকে এসে পড়লো। সে দু’কদম পিছিয়ে গেল। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে সে তুসিকে দেখতে পাবে না৷ যাকে দেখার তৃষ্ণায় ছয়টা মাস ছটফট করেছে। সেই অপেক্ষার ফল এতটা তিক্ত হবে কে জানত? জানলে ছয় মাস আগেই পরাণ বাসায় চলে আসত।
“ছয়মাস ধরে তুসি বাসায় নেই তাই তো? ছেলের কথায় চমকে উঠলেন রেহেনা৷ ছেলে যে এত সহজে সবকিছু ধরে ফেলবে। তার ঘুনাক্ষরেও টের পাননি তিনি৷ এখন সে ছেলেকে কি জবাব দিবে। ভয়ে পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে। বিনুর হাতে তুসির ফোনটা দেখতেই পরাণের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে খপ করে বিনুর থেকে ফোনটা কেঁড়ে নিয়ে বলল,
” তুসির ফোন তোর কাছে কেন বিনু?
“ভাইয়া তুসি যাওয়ার সময় সবকিছু রেখে গিয়েছে। তাই তুসির ফোন মা আমাকে দিয়ে দিয়েছে।
” তুই জানিস না কারো জিনিস অনুমতি না নিয়ে ধরতে হয় না। তাহলে তুই কেন তুসির ফোন নিয়েছিস। তুসি যদি চলে গিয়েই থাকে। তাহলে এতদিন আমার সাথে কথা বলেছে কে? আমার একটু একটু সন্দেহ হয়েছিল জানিস৷ কিন্তু তুসির জেদের কাছে আমি সেই কবেই হার মেনেছি৷ আমি ভিষণ বোকা তাই না। তা না হলে বোকার মতো তুসির মেসেজে বলা কথা গুলো বিশ্বাস করে নিয়েছি। আমি সব সময় চেয়েছি তুসি যেন কষ্ট না পায়। তুসির ভালো থাকাতেই আমার শান্তি। তুসি কষ্ট পাবে এমন কাজ কখনোই করিনি। আর তোরা আমার অনুভুতি নিয়ে খেললি! এতদিন তুসি সেজে তুই আমার সাথে কথা বলেছিস তাই না রে বিনু? পরাণের কথায় বিনু বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। ভয়ে সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। তখনই মাহবুব বের হয়ে আসেন। পরাণ কেমন জানি শান্ত হয়ে গিয়েছে। মাহবুবকে দেখে যন্ত্রণা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
“আব্বা আপনি তো তুসিকে ভালোবাসতেন। আপনি কেন তুসিকে হারাতে দিলেন। আপনি তো আমার মনের খবর জানতেন। আমি তুসিকে কতটা ভালোবাসি। সে খবর আপনার কর্ণ পর্যন্ত বহুত আগেই পৌঁছে দিয়েছি। তবে কেন আমায় এই বিচ্ছেদ যন্ত্রনা দিলেন। আমাকে মে’রে রক্তাক্ত করে দিন। আমার সব টাকা-পয়সা আপনারা নিয়ে নিন। আমাকে পথের ভিখারি বানিয়ে দিন। তবুও আমার তুসিকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন আব্বা। বাঁচতে পারব না আব্বা তুসিকে ছাড়া। মরে যাব আমি। তুসি বিহীন এ জীবন আমার মূলহীন। আমি আপনার পায়ে পড়ি আব্বা। ছোট বেলা থেকে যা বলেছেন। কখনো আপনার কথার অবাধ্য হইনি। কোনো জিনিসের জন্য বায়না ধরিনি। আজকে আপনার কাছে আমি তুসিকে চাইছি। আপনি আমার তুসিকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন। ছেলের আর্তনাদ বাবার হৃদয় স্পর্শ করে গেল। ভেতরটা হুঁ হুঁ করে উঠল। বাবা-মা ম’রা মেয়েটাকে সে নিজ হাতে এ বাসায় নিয়ে এসেছিল। ছোট থেকে নিজ হাতে বড় করেছে৷ সেই মেয়েকে সে কিভাবে বাড়ি ছাড়া করবে। সে কিভাবে ছেলেকে জবাব দিবে। তার ভালোবাসার মানুষকে সে আগলে রাখতে পারেনি। সে শহরের অলিতে-গলিতে খুঁজেছে তুসিকে। কোথাও তুসির দেখা মিলেনি। তুসির নামে নিখোঁজ অভিযোগ পর্যন্ত করা আছে। সে পরাণের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“তোর আব্বাকে মাফ করে দিস পরাণ। আমি তোকে দেওয়া কথাটা রাখতে পারিনি। আমার নিজেকে ভিষণ ব্যর্থ বাবা মনে হচ্ছে জানিস। সেদিন মেয়েটা আমার পা টিপে দিয়ে ঘরে গেল। সকাল থেকেই নিখোঁজ কোথাও খুঁজে পেলাম। কতজন লোক শহরের অলিতে-গলিতে লাগিয়ে দিলাম। পুলিশেও খবর দেওয়া হয়েছে। কেউ তুসির কোনো খোঁজ দিতে পারল না। আমি তোকে অনেক বার জানানো চেষ্টা করেছি। কিন্তু বিবেকের কাছে গেরে গিয়েছি বাজান। বাবা হয়ে ছেলের অশান্তি টেনে আনতে পারিনি বাজান। আমাকে তুই মাফ করে দিস। বাবার কথায় পরাণের ভেতরটা হাহাকার ভরে উঠল। সে নিস্তব্ধ হয়ে চেয়ারে বসে পড়ল। একটু পরে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,
” আমার পছন্দ ছিল সে। আর তার পছন্দ ছিল আমার ঠোঁট। সে ভালোবাসতো আমার বাবাকে আর আমি ভালোবাতাম তাকে। সে আমার মায়ের সব কথা শুনতো। আর আমি তার সব কথা শুনতাম৷ সে নিজের কষ্ট গুলো হালকা করার জন্য বিনুর কাছে মনের কথা বলত। আর বিনু সেটার সুযোগ নিয়ে ভাইয়ের প্রেমিকা হওয়ার প্রচেষ্টা চালালো। পরাণের কথায় বিনু মস্তিষ্ক ঝনঝন করে উঠল। মাহবুব লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিল৷ ছেলে আজ দিশেহারা হয়ে গিয়েছে। তার লাজুক ছেলেটাও নির্লজ্জ কথা বার্তা বলতে দ্বিধাবোধ করছে না। বিনু কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
“আমাকে তুমি মাফ করে দাও ভাইয়া। আমি তোমার সাথে এমন করতে চাইনি। আর মেসেজ গুলোও আমি করিনি। মা আমার থেকে সবকিছু শুনে মা তোমার সাথে মেসেজ করেছে। মা যখন কাজ করেছে। তখন আমাকে দিয়ে তোমাকে মেসেজ দেওয়াইছে। বিনুর কথায় রেহনার হুংকার দিয়ে বলল,
” দিয়েছি বেশ করেছি। ঐ দুই টাকার মেয়ের জন্য পরাণ এখন আমাকে খু’ন করবে নাকি। বাহিরের মেয়ের জন্য সে যদি আমাকে খু’ন করতে পারে। তাহলে আমি ছেলের হাতে খু’ন হতে রাজি আছি৷ রেহেনার কথা শেষ হতেই পরাণ খাবার ঘরটাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে শুরু করল পরাণ। পরাণের ভয়ংকর রুপ দেখে সবার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। পরাণ একটু পরে শান্ত হয়ে গেল৷ পরিবেশ নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। রক্তিম চোখে একবার মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করল৷ রক্তাক্ত হৃদয় নিয়ে নিজের কক্ষ প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দিল।
চলবে……