‘এই ঝুম সন্ধ্যায় এখানে কি করছো তুমি?’
প্রিয়তা হালকা নড়বড়ে হয়ে উঠলো অভীর এমন আগ্রাসী কথায়। রিক্সা থেমে আছে। বৃষ্টি থামবার কোনো গতি নেই। এরই মধ্যে নিজের আদ্র হাত দিয়ে অভী চেপে আছে প্রিয়তার হাত। প্রিয়তার নিঃশ্বাস এলোমেলো হয়ে এলো। সিক্ত অভীর সুঠামদেহে টপাটপ বৃষ্টির কণা পড়ায় দৃষ্টি বিভ্রম হলো। কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে তাই সে বললো,
‘ প্রাণোদের বাসায় গিয়েছিলাম আমি। ওর বোনকে আমি পড়াই।’
চোখ সরু হলো অভীর। ভাবাবেগ প্রিয়তার বোধগম্য হলো না। অভী ঠোঁট হালকা নাড়ালো। নিখাদ স্বরে প্রশ্ন করলো,
‘ এই সময়ে?’
এতক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে গেলো প্রিয়তা। বলে উঠলো,
‘ এই সময়ে বলতে পড়া আগেই শেষ কিন্তু বৃষ্টির জন্য আন্টি বের হতে দিচ্ছিলো না। আর এমনিতেও সন্ধ্যার সময় তাই আন্টি আমার সেফটির জন্যই প্রাণোকে আমার সাথে পাঠিয়েছে।’
অভী সচকিত হলো৷ প্রিয়তা এখনও বুঝতে পারলো না এই ছেলে বাইক নিয়ে কোথা থেকে টপকালো। কিছুক্ষণ আগে তো তাকে এক্টিভ দেখলো ফেসবুকে। তাই ধারনা হয়েছিলো নিজের বাড়িতেই হয়তো ছিলো৷ কিন্তু অভীকে এভাবে দেখে ধারনা পাল্টে গেলো এখন। অভী এবার দৃষ্টি ফেললো প্রাণোর দিকে। বললো,
‘ তোমার না সামনে পরীক্ষা প্রাণো?’
প্রাণো সচকিত হলো। প্রাণো যে কোচিংয়ে কেমিস্ট্রি পড়ছে সেখানে অভী ওর গাইডলাইন হওয়াতে সম্মানের সহিত বললো,
‘ জ্বি ভাইয়া।’
‘ তাহলে যাও, বাড়িতে যাও। তোমার কাছে তো ছাতা আছেই তাই যেতে কোনো অসুবিধা হবে না। বাসায় গিয়ে ভালোমতো পড়ো। কোনো পড়া বুঝতে সমস্যা হলে যত রাতই হোক ফোন করতে পারবে। প্রিয়তাকে আমি দিয়ে আসবো।’
অভীর নিশ্চল কথাবার্তায় কিছুক্ষণ থম মেরে রইলো প্রিয়তা। বোধ টা স্নায়ুর দরজায় কড়াঘাত করতেই সাথে সাথে কঠোর কন্ঠে বললো,
‘ তার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রাণোই দিয়ে আসবে আমায়।’
প্রিয়তার কন্ঠ কঠোর। বস্তুত প্রিয়তা কখনোই সবার সাথে এভাবে কথা বলে না। অভীর সাথে তো না ই। আর আজ সেই প্রিয়তাকে এতটা অকপটে দ্বিরুক্তি করতে দেখে অভীর আশ্চর্যের যেন সীমা রইলো না।
প্রিয়তা নিজেও অবাক নিজের এমন ব্যবহারে। এর কারনও অবশ্য অভী। ছেলেটা সবার সামনে তাকে তুখড়ভাবে এড়িয়ে চলাতে তা যেন আত্মসম্মানে লেগেছিলো। প্রিয়তা অজান্তেই যখন অভীর দিকে বারবার তাকালো আর ইট পাথরে গড়া অভী একবারও সেদিকে না তাকিয়ে বন্ধুদের সাথে কথা বলায় মশগুল ছিলো সেটা যেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাগ ছড়িয়ে দিলো। মনের অন্তঃকরণে বিদ্রোহ হলো যে,
‘ অভী নিষ্ঠুর, ভীষণ নিষ্ঠুর!’
অভী হাত ভাঁজ করলো। ভাঁজ করা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো প্রিয়তার দিকে। বললো,
‘ আমার সাথে গেলে সমস্যাটা কি?’
‘ অনেক সমস্যা, আমি যাবো না ব্যাস। হবু বর আপনি আমার। সেই হবু বর শব্দটাও ভীষন নড়বড়ে। পার্মানেন্ট নন যে আপনি যা বলবেন আর পুতুলের মতো সবটা মেনে নিবো। ‘
প্রাণো ড্যাব ড্যাবিয়ে তাকিয়ে আছে। অভীর সাথে কেউ যে এভাবেও কথা বলতে পারে সেটাও ওর কল্পনার বাইরে। অভী কিছুক্ষণ অনিমেষে তাকিয়ে থাকলো। মুখের ভাবনা বোঝা যাচ্ছে না৷ বৃষ্টির তুমুল গতিতে চোখ হয়ে আসছে ছোট ছোট। বলে উঠলো,
‘ এবার একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?’
‘ বাড়াবাড়ি টা আমার তুলনায় আপনি বেশি করছেন না? বলছি তো প্রাণো আছে আমার সাথে। আপনি ব্যস্ত মানুষ, সময়ে অসময়ে এমন ভাব করেন যে চিনেনই না আমাকে, তার জন্য আপনাকে এতটা কষ্ট করতে হবে না।’
অভী যা অবাক হচ্ছিল প্রিয়তা তার থেকে দ্বিগুণ
অবাক হলো নিজের কথায়। মনে মনে নিজেকে নিজেই পুরষ্কৃত করলো দু’চারটা ভয়ঙ্কর কথা অভীর মুখের ওপর ছুঁড়ে মারতে পেরেছে বলে। অভীর দিকে তাকালো সে। ছেলেটা সে ভঙ্গিমায়তেই দাঁড়িয়ে আছে। রিক্সাওয়ালা মামা হাসছে। পান খাওয়া মুখে অন্যরকম সে হাসি। তার চিন্তাধারা এরূপ যে ধারাবাহিক নাটকের কোনো ক্লাইমেক্স সিন চলছে এখানে। প্রিয়তা থমকালো। অভীকে এতক্ষণ বৃষ্টিতে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলতে ইচ্ছে হলো যে,
‘ মৌসুমটা ভালো না, আপনি ফিরে যান!’
কিন্তু মস্তিষ্ক তার বিপরীত কার্যপ্রবাহ চালালো। মন একবার যেহেতু অভীকে বিদ্বেষী ঘোষণা করেছে সে মন কিছুতেই এবার নরম করা চলবে না। নীরবতা কাটিয় প্রিয়তা রিক্সাওয়ালা মামাকে বললো,
‘ বাইক বাইকের জায়গায় খাম্বা হয়ে থাকুক মামা। আপনি ঘুরিয়ে চলে যান।’
অভী এবার আচমকা একটা কাজ করে বসলো৷ থমথমে কন্ঠে বললো,
‘ প্রানো কি বলেছিলাম তোমায় শুনেছো?’
‘ জ্ব-জ্বি’
প্রাণোর ভীত কণ্ঠস্বর।
‘ তবে এখনও বসে আছো কেনো? ছাতা নিয়ে চুপচাপ বাসায় হেঁটে যাও। এক কাপ চা বানিয়ে বই খুলে মনোযোগ দিয়ে পড়ো।’
প্রাণো দাঁড়ালো না আর। নিঃশব্দে রিক্সা থেকে নেমে চলে গেলো। প্রিয়তা তড়িঘড়ি করে বললো,
‘ একি বাচ্চা ছেলেটাকে……’
প্রিয়তাকে বলতে দিলো না অভী। বাইক একপাশে রেখেই ভেজা শরীর নিয়ে ঝড়ের গতিতে রিক্সায় চেপে বসলো। প্রিয়তা হতভম্ব। দৃশ্যপট যেন ধারনার বাইরে চলে গেলো। নিজেকে মনে হতে লাগলো দুধর্ষ কোনো নগরের অবলা রাজকুমারীর মতো। অভী নিরুদ্বেগে বললো,
‘ সিন শেষ মামা। রিক্সা চালান!’
যথারীতি তাই হলো। প্রিয়তা এবার সত্যি সত্যি ফেটে পড়লো রাগে। অন্তরে জমে উঠলো ক্রোধ। বললো,
‘ কিসব পাগলামি করছেন আপনি? এমন করার কোনো মানে আছে। আপনি আসলেই…..’
‘ শক্তি সঞ্চয় করো প্রিয়তা। এই বজ্রপাত আর তোমার শব্দ আমার কাছে একই ভাবে কর্কশ মনে হচ্ছে। কিছু তো বুঝবোই না উল্টা তোমার গলা ভাঙবে।’
অপমানে রি রি করে উঠলো প্রিয়তার সারা শরীর।।আকিঞ্চন হয়ে উঠলো ঠোঁটের সরু সিক্ত পল্লব। অপমানটা হজম করতে বেশ কষ্টই হলো। রাগে ক্ষোভে তাই চুপচাপ বসে রইলো সে। চোখে অশ্রু ভীড় করছে। অভীর কাছে হেরে যাওয়ার ব্যর্থতা মেনে নিতে বেজায় কষ্ট হচ্ছে। মনে মনে অভীকে বেশ কয়েকটা কথা শোনালো। আওড়ালো একই কথা। এর শেষ সে দেখেই ছাড়বে৷
উঁচু নিচু রাস্তায় দুলে উঠছে রিক্সা। বারবার প্রিয়তা টের পাচ্ছে অভীর বাহুর স্পর্শ। প্রিয়তা অপ্রতিভ হলো। সেই স্পর্শের সাথে ভিজে গেলো কামিজের হাতাটি। অভীর সাথে রিক্সায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা প্রিয়তার এই প্রথম। এই প্রথম অভিজ্ঞতা কোনো বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় এমন একজন পুরুষের সাথে যাওয়া৷ অভী এবার বললো,
‘ প্রিয়তা?’
প্রিয়তা নিশ্চুপ। কোনো প্রতিউত্তর দিলো না।
‘ এই সময়ে এই গলিতে কাউকে পড়াবে না। আমাদের এই লেনটা ভালো না। কাঁঠালবাগানের মোচরেই বখাটে ছেলেপেলেরা থাকে। দরকার কি শুধু শুধু রিক্স নেওয়ার?’
প্রিয়তা তবুও নিরুত্তর। অল্পসময়ের মধ্যেই প্রিয়তার বাসার কাছে এসে পড়লো রিক্সা। মামা থামালো। পশ্চিম আকাশে আবছা আভা দেখা দিচ্ছে। সেটাও প্রায় অন্তিম পর্যায়ে। একটু পর ঝুপ করে আঁধার নামবে৷ মায়াবী লাগবে এই চট্টগ্রাম শহর। বারান্দায় অনায়াসে একটা বই নিয়ে বসে পড়া যাবে। অদ্রি যদি রাতে কারও সাথে প্রেমালাপ না করে তবে তো আরও ভালো।
প্রিয়তা রিক্সা থেকে নামলো। অভী সেখানেই বসে রইলো। বললো,
‘ যাও তাহলে।’
‘ আপনিও আসেন। মা বা দাদী যদি শুনে যে দরজার কাছে এসেই আপনি চলে গিয়েছেন তাহলে রাগ করবে আমার সাথে।’
প্রিয়তার মলিন উত্তর। স্পষ্ট ভাবাবেগ যে সে চায়না এখন অভী আসুক। মলিন হাসলো অভী। বললো,
‘ কাজ আছে আমার। আল্লাহ চাইলে অন্য একদিন আসবো।’
রিক্সা ঘুরানোর আগে অভী গম্ভীর স্বরে বললো,
‘ টেক কেয়ার! ‘
রিক্সা ঘুরে গেলো। সেটা বৃষ্টির সাথে ধুয়ে গেলো রাস্তায়। প্রিয়তা অনিমেষে সেদিকে তাকিয়ে থাকলো।
__________________
দুটো দিন চলে গেলো বাতাসের মতো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার মধ্যেই এখন পাহারসমান ক্লাসের চাপ৷ এক এক ভবনে একের পর এক ক্লাস করে অতিষ্ঠ সবাই। তাপদাহ গরমে মোড়ের আখের রস খেলে আলাদা এক শান্তি পাওয়া যায়। প্রিয়তা আজ নীরব। চুপচাপ নোটসগুলো নিয়ে বসে আছে ক্যাম্পাসে।। অভীর দুদিন ধরে খবর নেই কোনো৷ খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে ছেলেটা ইউনিভার্সিটিতেও আসছে না।
অদ্রি মসলামাখানো আমড়া খাচ্ছিলো বসে বসে। বলে উঠলো,
‘ কি ভাবছিস এত?’
‘ কিছুনা।’
মুখে কিছু না বললেও ওর মনে হাজারো প্রশ্নের আনাগোনা। হতাশায় চোখ সরিয়ে নিতে যাবে তখনই অদূরে চোখ পড়লো নীল চেক শার্ট পরিহিতা অন্তুর দিকে। অন্তু। এককথায় অভীর কাছের বন্ধু বলা চলে। সে হয়তো এদিকে এসেছে কারও সাথে দেখা করতে।
প্রিয়তা কথা না বাড়িয়ে তার দিকে এগোলো। বলে উঠলো,
‘ কেমন আছেন ভাইয়া?’
অন্তু ফিরে তাকালো। সেই বিনয়ী হেসে বললো,
‘ ওহ প্রিয়তা তুমি? এইতো ভালো। তোমার কি অবস্থা?
‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো।’
প্রিয়তা সরাসরি অভীর কথা প্রশ্ন করতে পারলো না৷ বললো,
‘ কেমন চলছে আপনাদের দিনকাল? ‘
‘ আমার আর কি? প্যারায় আছি। আমাদের এই ব্যাচ যে কি করবে খোদাই জানে।’
প্রিয়তার মনে মনে রাগ হলো। আপনাদের বলতে কি বুঝিয়েছে সে কি বুঝেনা?
‘ আপনাদেরই বাকি বন্ধুরা কোথায়?’
‘ ওহ আসছে ওরা। ক্লাস শেষ তো, এখন অভীর বাসায় যাবো দেখা করতে।’
এইতো পেলো সুযোগ। চট করে বললো,
‘ কেন কি হয়েছে?’
অন্তু বিষম খেলো। এমন ভান করলো যে প্রিয়তার কাছ থেকে এমন উত্তর আশা করেনি। বলে উঠলো,
‘ কেন তুমি জানো না প্রিয়তা যে অভীর জ্বরে অবস্থা খারাপ?’
.
.
.
.
#চলবে
রিচেক করা হয়নি। দ্রুত দিয়ে দিলাম।
মন্তব্যের আশা করছি।