মাঝরাতের বর্ষণকে বলা হয় প্রেমের বর্ষণ। এসময় প্রকৃতি হয়ে যায় স্নিগ্ধ। চট্টগ্রামের মতো এলোমেলো পাহাড়ি শহরে সেই মুগ্ধতা যেন আরও চনমনে হয়ে ওঠে। বাতাসে হাসনাহেনার মতো প্রেমের ঘ্রাণ। প্রিয়তা নিভে যাওয়া আলোর মতো বারান্দার দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো। ঘড়ির কাটা বারোটায় হানা দিয়েছে। পেছনের খাটে স্তব্ধমূর্তির মতো বসে থাকা রুদ্র আর অদ্রি। অরিন নেই। সে পাশের রুমে গলা ফাটিয়ে ত্রিকোণমিতির সূত্রগুলো মুখস্থ করছে। কানে আসছে সেগুলো প্রিয়তার।
নীরবতার কাটিয়ে হঠাৎ অদ্রি বললো,
‘ অভী ভাইয়া সেদিন তোকে এত ভয়াবহ কথাগুলো বলে গেলো আর তুই জানাচ্ছিস এগুলো এখন?’
প্রিয়তা অবনত হলো। সবিস্ময়ে বললো,
‘ এগুলো আর যাই হোক তোকে বলার মতো কিছু না অদ্রি। তোকে আমি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভয় পাই। পরে দেখা যাবে, এলাকার সদ্য ফুটে ওঠা বাচ্চারাও জানবে সেদিন উনি আমায় কি বলেছিলো।’
এমন কটুক্তি শুনে নাক ফোলালো অদ্রি। রুদ্র হাসছে। বললো,
‘ যাক! কাহিনী দেখি টার্ন খেলো মাম্মা। অভী ভাইয়ার মতো মানুষও পাল্টি নিলো। কত না বলতি, ব্যাটায় ঘাড়ত্যাড়া, নাকের ডগায় ইগো। কথা বলে না, হাসে না। আর সেই ব্যাটায় এখন তোকে যেভাবেই হোক, বিয়ে করবে বলে পণ করেছে। পুরাই জোস!’
‘ তোর জোসের মাথামুণ্ডু। শুন রুদ্র- আমি, এই অদ্রি থাকতে প্রিয়ুর বিয়ে ওই ঘ্যাড়ত্যাড়া ব্যাটার সাথে হবে না। তার সুদর্শন রূপ তুই ধুয়ে খা। কি পেয়েছে টা কি ওই শালায়? ইচ্ছে হলে সবার সামনে অপমান করে বেড়াবে, আর ইচ্ছে হলে ধরে বেঁধে বিয়ে করবে? মেয়েদের কি এরা মানুষ মনে করে না? তোরে কি বলবো? ছেলেমানুষদের জাতই হলো ছুইচ্চার জাত। একজন দিয়ে জীবনেও এদের পেট ভরবো না। আজ আমাদের প্রিয়ুরে তুলুতুলু করে রেখে ঠিকই তোর মতো অন্য মেয়েদের টাংকি মারবে।’
অদ্রির ছেলে বিদ্বেষী মনে এবার হানা দিলো ইতিহাসের রমনীর মতো বিদ্রোহ। আর অদ্রির প্রকোপে সায় দিলো প্রিয়তাও। রুদ্র হাজারটা বোঝানোর পরও প্রিয়তা কেন যেন সবকিছু ধাতস্থ করতে পারলো না। অদ্রি এবার বললো,
‘ শোন প্রিয়ু! আমি অভী ভাইয়ার ব্যাপারটা বুঝে শুনেই বলছি। অভী ভাইয়া ছেলে হিসেবে পার্ফেক্ট, বাট তোর জন্য না। যেই ব্যাটায় আমার জানুকে সবার সামনে ধমকে বেড়াবে তার সাথে কিছুতেই আমি বিয়ে হতে দিবো না। দরকার হলে বিয়ের দিন তাকে কিডন্যাপ করে বস্তায় ভরে পানিতে ফেলে দিয়ে তার বন্ধু অন্তুর সাথে সুখের সংসার করবো, তবুও না।’
এভাবে কথা বলতে বলতে কেটে গেলো সময়। অদ্রি এখন যত সাহস দেখাচ্ছে, অভীর সামনে তা এক চুলও পারবে না এটা রুদ্র, প্রিয়তা দুজনেই ভালোমতো জানে। প্রিয়তা এবার পাশের রুমে গেলো। দেখলো অরিন পড়ছে এখন গভীর মনোযোগে, তারই পাশের রুমে যে ওরা তিনজনে বিরাট আলোচনার পর্ব শেষ করলো তার কোনো হদিস নেই। প্রিয়তা ঢুলুঢুলু হয়ে বললো,
‘ কিরে ঘুমাবি না?’
‘ এইতো আসছি। রুদ্র ভাইয়া চলে গিয়েছে? ‘
‘ হুম! ও এতক্ষণে ঘুমিয়েও গেছে মনে হয়।’
‘ অদ্রি আপু কই? আমি ওই রুমে পড়লে তো আপুর আর প্রেমালাপ হয় না ভালোমতো। তাই তো এ রুমে এসে পড়ছি রাতে। সেদিন কোন ছেলের সাথে নাকি কথা বলছিলো, আমি তখন টেবিলে বায়োলজি পড়ছিলাম। এসে কি ধমক! বললো, ‘ বায়োলজি এভাবে চিল্লিয়ে পড়বি না আমার সামনে!”
অরিনের অভীমানি কন্ঠে হেসে দিলো প্রিয়তা। বললো,
‘ আরে ওর কথা! এখন বই রেখে ঘুমাতে আয়। সন্ধ্যার পর থেকে দেখছি পড়েই যাচ্ছিস, এসএসসিতে গোল্ডেন পাইতে চাইলে পড়বি ভালো কথা। এজন্য নিজেকে এত হেয়ালি করবি?’
‘ আরে কাল পরীক্ষা আছে স্কুলে, বিকেলে তিথী চাচীর সাথে গল্প করার সময় তো মনেই ছিলো না একথা। জানলে এমন হতো না।’
লাইট অফ করে নিজেদের রুমে ঢুকলো দু’জনে। অদ্রি ঘুমুচ্ছে মরার মতো। ঘুমের মাঝে ভুত ভূত বলে চেঁচিয়েও উঠেছে। বৃষ্টির গতি কমেছে। পরিবেশ এখন শীতল, স্যাঁতসেতে। অরিন বললো,
‘ আপু, ঘুম আসছে না!’
‘ তোরও কি অদ্রির মতো প্রেম প্রেম পায় নাকি?’
‘ কি যে বলো? আমার দু’দিন বাদে পরীক্ষা আর এসবে সময় দিবো ভাবছো? আচ্ছা শুনো না? তোমার এরকম ফিলিং হয় না?’
‘ কি রকম?’
‘এইযে প্রেম প্রেম টাইপ ফিলিং? মাঝে মধ্যে অভী ভাইয়ার সাথে কথা হয়না লুকোচুরি করে?’
প্রিয়তার মনে বিস্ফোরণ ঘটলো। অরিন তো এমন মেয়ে নয়? তাহলে এসব কি বলছে?
‘ তুই কি মিথি নামের কাউকে চিনিস তোর স্কুলের? ‘
‘ চিনবো না কেন? তুমিই তো ওকে পড়াও। ‘
‘ ওর থেকে দশহাত দূরে থাকবি? কেন যেন মনে হচ্ছে ওর ভাইরাস তোর মাথায় ঢুকেছে।’
অরিন চোখ ছোটো ছোটো করে ফেললো। বুঝলো প্রিয়তা খানিকটা রেগে গেছে একথায়। ওর আগেই বোঝা উচিত ছিলো প্রিয়তা ওমন মেয়ে না৷ অদ্রি আপুর সাথে উঠেবসেও প্রিয়তার মধ্যে ওই ব্যাপারটা আসেনি। অরিন জড়িয়ে ধরলো আপুকে৷ বললো,
‘ আচ্ছা সরি। আর জীবনেও এমন প্রশ্ন করবো না। এখন চুলে বিলি কেটে দাও তো!’
প্রিয়তা হেসে আনমনে চুমু খেলো অরিনের কপালে।
________________
নন্দলাল সড়কে তুমুল ভীড়। স্কুল ছুটি হওয়াতে হুড়মুড় করে বেরোচ্ছে ছেলে-মেয়েরা। কাঠফাটা রোদ। বিভৎস বাতাস। প্রিয়তা অপ্রতিভ হলো। ঘেমে নেয়ে একাকার হলো বেগুনি সুতির জামা। গাছের শুকনো পাতার ফাঁকফোকড়ে হানা দিয়ে আসা রোদ পড়ছে মুখ আর বাদামী চোখের ওপর। ঠোঁটজোড়া জিভ দিয়ে ভেজালো বারকয়েক। তিক্ত লাগছে সময়। নাহ! মিথি তো বের হবার নামই নিচ্ছে না স্কুল থেকে।
জীবনে যতগুলো স্টুডেন্ট পড়িয়েছে, এই এক মিথিকে পড়িয়ে ওর জীবনের কষ্ট বেড়ে গেলো রেলইন্জিনের ধোঁয়ার মতো করে। আজ সকালে মিথির মা ফোন দিয়ে প্রিয়তাকে বলেছে স্কুলের অপজিটে বইয়ের দোকান থেকে ওর একটা বই কিনে দিতে। তিনদিন ধরে তিনি মিথিকে তাড়া দিচ্ছিলেন অথচ মেয়েটার কোনো রা শব্দ নেই।
বেশ কিছুক্ষণ পর এলো মিথি৷ প্রিয়তাকে দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসি দিলো। বই কিনতে সময় চলে গেলো আরও। তারপর মিথি হাহাকার কন্ঠে বললো,
‘ ও আপু একটা পেস্ট্রি টেস্ট্রি খাইয়ে দাও না? ক্ষুধায় পেটে ইঁদুর ডিস্কো ডান্স করছে!’
প্রিয়তা ওকে নিয়ে মোড়েরই একটা শপে গেলো। কিনে দিলো চকলেট মিনি সাইজ কেক। তবে সেখানে গিয়ে আরও অপ্রত্যাশিত ব্যাপার ঘটলো। শান্তনু প্রিয়তাকে দেখে খুশিতে চেঁচিয়ে বললো,
‘ আরে বউমনি?’
কেঁপে উঠলো প্রিয়তা। পেছনে ফিরে হতভম্ব হলো। শান্তনু দাঁড়িয়ে আছে, নাদুসনুদুস শরীরের পেছনে ঝুলানো স্কুল ব্যাগ। গাল গুলো লাল হয়ে আছে রৌদ্রে দৌড়াদৌড়ির কারনে। পাশে দাঁড়ানো তার হবু শ্বশুরমশায় ওরফে নুরুল স্যার। সবসময়ের মতো ফর্মাল লুক। চোখে চশমা। ভদ্রলোক রাগী মানুষ, কলেজে পড়াকালীন সকল ছাত্রছাত্রীরাই তাকে গম্ভীর বলে চিনতো৷ তবে প্রিয়তাকে দেখে তার ঠোঁটে প্রানবন্ত একটা হাসি। ঘটনা এখানেই শেষ হলেও পারতো। তবে প্রিয়তার ভাগ্য এখন চলমান উপন্যাসের পাতার মতো। অবাকতার রাজ্যে হানা দিতে না দিতেই শপের দরজা দিয়ে ঢুকলো অভী। তার চোখের সানগ্লাস ইতিমধ্যে খুলে শার্টে ঝুলিয়ে রেখেছে। বিস্ময় ভাব অভীর চোখেমুখেও। তবে তার চেয়ে বেশি রম্য হাসি।
মিথি খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,
‘ বাব্বাহ! পুত্রবধূর ঠিকানা পেয়ে একই সাথে শ্বশুড় দেবর, বর সবগুলো উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। কাজি ডাকো আপু, এক্ষুণি বিয়ে সেরে ফেলো এই মুহূর্তকে স্মরণীয় বরণীয় রেখে। সাক্ষী নাহয় আমি থাকবো!’
.
.
#চলবে