অভীর জ্বরের কথা শুনে কিছুক্ষণ প্রিয়তা স্তব্ধ হয়ে রইলো। অনিমেষে তাকিয়ে থাকলো অন্তুর দিকে। ছেলেটার চোখে মুখে এখনও রাজ্যের বিস্ময়তা। ভাবখানা এমন যে অভীর তথাকথিত হবু বউ হিসেবে তার গা কাঁপানো জ্বরের কথা না জেনে প্রিয়তা যেন বড় পাপ করে ফেলেছে। মহাপাপ। এ পাপের জন্য অবশ্যই উচিত তাকে সুপ্রিম কোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জবাবদিহিতা করা।
প্রিয়তা ঢোক গিললো। অতি সন্তর্পণে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
‘ উনার জ্বর?’
‘ হ্যাঁ।’
‘ কবে থেকে?’
অন্তুর চোখে ভাঁজ পড়লো। সন্দিহান হয়ে বললো,
‘ সত্যিই জানো না কিছু?’
‘ না তো!’
অপ্রস্তুত হলো প্রিয়তা। সে ভালো করেই জানে অন্তুকে ইনিয়ে বিনিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না। কিছুতেই না। অভীর ভাই সমান এই বন্ধুটির তুমুল সিক্স সেন্স পাওয়ার। সহজেই কথা ধরে ফেলতে পারে। অন্তু হাত ভাঁজ করলো। বললো,
‘ তা প্রিয়তা অভীর হবু বউ হিসেবে তোমার কি যাওয়া উচিত না ওকে দেখতে যাওয়া?’
বিস্ফোরিত হলো প্রিয়তার চোখ। মাথায় ভেতর আদুরে পাখির বাসা ঘুরপাক খেতে লাগলো। কথাটি অন্তুর ভুল না। অবশ্যই সঠিক। তবে এটাও সঠিক যে অভী প্রিয়তার কাছে সাময়িক আপদ মাত্র। নিজকে আশ্বস্ত করে সে বললো,
‘ অবশ্যই দেখতে যাওয়া উচিত। কিন্তু আমি যেহেতু জানতাম না তাহলে আমার ওপর পুলিশের উচ্চতর কর্মকর্তার মতো অর্ডার করা উচিত অন্তু ভাইয়া? আমি যাবো, এখন যেহেতু জেনেছি অবশ্যই যাবো।’
মনে মনে নিজেকে বাহবা দিলো সে। কথাগুলো গুছিয়ে বলতে পারাতে মনে স্বস্তি এসেছে। কিন্তু সেই স্বস্তিও খানিকবাদে চলে গেলো বাতাসে ভেসে আসা মেঘের মতো। অন্তু বললো,
‘ যাবো বলবে না এখন, বলো যাচ্ছি। তুমি এখনই আমাদের সাথে যাচ্ছ প্রিয়তা। এখনই মানে এখনই!’
প্রিয়তা কিয়ৎক্ষণ নিস্তব্ধ। অন্তু কথাটাই বলেছে ভড়কে যাওয়ার মতো। চিৎকার করে বললো,
‘ এখন মানে?’
‘ এখন মানে বুঝো না? এখন এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ”Now”…., এবার বুঝেছো?’
এমন কটুবাক্যে থমথমে হয়ে গেলো প্রিয়তার মুখ। অভী যেমন, অন্তুও তেমন। অপমানে গা জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো। প্রিয়তা ভেবে পেলো না কিভাবে এর থেকে পরিত্রাণ পেতে পারবে। তবে মুখের ওপর না বলা কোনোভাবেই সম্ভব না। অন্য উপায় খুঁজে বের করতে হবে। প্রিয়তা তবুও দ্বিরুক্তি নিয়ে বললো,
‘ আপনারা যান অন্তু ভাইয়া, অভী আপনার বন্ধু। আমার না। আমার আপনাদের সাথে যাওয়াও মানায় না। বাসায় যাই, একটা টাটকা গোসল দেই। তারপর রুদ্রকে নিয়ে আমি যাবো উনাকে দেখতে।’
‘ আর আমাদের সাথে গেলে সমস্যাটা কি? আমি কি একবারও বলেছি তুমি আমাদের বন্ধু? চুপচাপ রাজি হয়ে যাও। সম্পর্কে আমার ভাবি হলেও এই ভাববে না আমি তথাকথিত মানুষদের মতে ভাবি ভাবি বলে মুখে সাবানের ফ্যানা তুলবো। তবুও তোমায় সম্মানে ডাকছি মিস পটেটো। চলো।’
‘মিস পটেটো’ ডাকটা শুনলেই প্রিয়তার গায়ে জ্বলুনি ধরে যায়। প্রিয়তার এখনও মনে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দিনটির কথা। আইটি ভবনের দৃশ্যপট ছিলো চমৎকার। সেসময় হঠাৎ ঘিয়ে রঙের শার্ট পড়া এক ছেলে ইশারায় ডেকে বলে,
‘ হেই রেড গার্ল!’
প্রিয়তা সচকিত হলো। পিছে ফিরে ভবনের বাম পাশের উত্তাল লনের প্রান্তে কয়েকজনের সমারোহ। প্রিয়তা এগুলো, সাথে ছিলো অদ্রিও। ছেলেটা বললো,
‘ ফ্রেশার?’
সেদিন ঢোক গিলেছিলো প্রিয়তা। আজীবন শুনেছে ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষে নাকি ভয়াবহ ধরনের ragging হয়। তাহলে ওরাও কি এই পরিস্থিতির শিকার হলো? এই দল দেখে নিঃসন্দেহে ধরা যাচ্ছে তারা সিনিয়র স্টুডেন্ট। ঢোকে গিলে তাই সে বলেছিলো,
‘ হুম!’
উজ্জ্বল হলদেটে গায়ের ছেলেটা হাসলো। অদ্রি আর রুদ্রিকের দিকে একপলক তাকিয়ে প্রিয়তার দিকে মনোনিবেশ করলো। বললো,
‘ নাম কি?’
‘ প্রিয়তা?’
‘ হোয়াট! পটেটো? সেটা আবার কেমন নাম? তো তোমার নাম পটেটো হলে বাবা মায়ের নাম বেগুন, মিষ্টিকুমড়া এমন কিছু নাকি? ‘
মুখ কালো হয়ে গেলো প্রিয়তার। ছেলেটার সাথে বাকিরাও হেসে উঠছে। অদ্রি তেড়েমেড়ে বললো,
‘ কানে ভালোই ময়লা জমেছে ভাইজান। ওর নাম প্রিয়তা বলেছে। তাহমিনা প্রিয়তা! ‘
মনে মনে সে একটু ক্ষুব্ধ হলো অদ্রির প্রতি। রেগেমেগে দু’চারটা ভয়াবহ কথা শুনাতে যাবে তখনই পেছন থেকে তাকে কেউ ডাক দিলো,
‘ অন্তু?’
সেদিনই অন্তুর প্রথম নাম জানলো প্রিয়তা। সেই সাথে এটাও জানলো সে অভীর বন্ধু। কেননা যে তাকে ডেকেছিলো সে অভীই ছিলো৷ অভীকে দেখে প্রিয়তা অবাক হয়েছিলো সেদিন৷ প্রিয়তা জানতো অভী চবিতেই পড়ে। তবে এর বেশি কিছু জানতো না। ডানপিটে গড়নের শরীরে উজ্জ্বল চেক শার্ট, চুলগুলো সুন্দরভাবে ব্রাশ করা জানান দিচ্ছিলো অভীর নিখুঁত সৌন্দর্যের। দাপুটে কন্ঠে সে বললো,
‘ ওদের ছেড়ে দে। আমার বাবার স্টুডেন্ট। ‘
‘ যাক শালা!’
অন্তু বিরক্তি নিয়ে তাকিয়েছিলো সেদিন। তারপর যন্ত্রণা কমে গেলেও ক্যাম্পাসে, হলে, ক্যান্টিনে ছেলেটা যখন তখন পটেটো বলে চেঁচিয়ে উঠতো। আজ যেমনটা বলেছে।
প্রিয়তা ব্যথিত নয়নে তাকালো অন্তুর দিকে। মুখে স্পষ্ট ভাব প্রতীয়মান সে যাবে না। আদুরে ভঙ্গিতে জানান দিচ্ছে ওর সাথে এমন না-ইনসাফি না করার। কিন্তু অন্তুও সমানতালে বললো,
‘ চলো, আর চাইলে তোমার দুই সিপাহী রুদ্র অদ্রিকেও নিয়ে আসতে পারো মহারানী।’
অগত্যা আর কোনো উপায় রইলো না প্রিয়তার। মনের বিরুদ্ধেই সে অস্বস্তি নিয়ে যেতে রাজি হলো। অভী কেমন প্রতিক্রিয়া করবে কে জানে!
_______________________
অভীদের বাড়ির নাম ‘কান্তা ভিলা’। বাড়ির দোরগোড়ায় দেয়ালে ঝুলন্ত রূপালী রঙের নেমপ্লেটে এই নামটি দেখলে আপাতত হুমায়ূন আহমেদের সেই ‘কান্তা ভিলা’র কথাই মনে পড়বে। মেঘের ছায়া উপন্যাসের কান্তা ভিলার মতোই বাড়িটি ছিমছাম।।সামনে বিশালাকার জায়গা। তার সম্মুখেই গর্বিত মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে শ্রীশদাস লেনের অতীব সুন্দর এই বাড়িটি।
অভী এখন তার বাবার স্টাডি রুমের বারান্দায় বসে রোদ পোহাচ্ছে। ভয়াবহ জ্বর নিয়ে এই রোদ পোহানোর কোনো মানে হয়না। তবে জ্বর আসলে এসব পাগলামি হুট করেই মাথায় দেওভূতের মতো চেপে ধরে- তাই এখানেই বসে রইলো সে। রোদটা আদুরে ভঙ্গিতে গায়ে মিশছে। আরামদায়ক না হলেও ভালোলাগছে গত দুদিনের তুলনায়। জ্বর জিনিসটাকে অভী ভয় পায়, একটু বেশিই ভয় পায়৷ বাড়ির বড় ছেলে হওয়ার জন্য দাদা দাদী মায়ের কাছে বড্ড আদুরে ছিলো। বৃষ্টিতে ভেজার সৌভাগ্য বা স্বাধীনতা যেটাই দেওয়া হোক না কেন খুব বেশি উপভোগ করতে পারেনি৷ এমনিতে শরীর স্ট্রং থাকলেও একমাত্র বৃষ্টির বরফ শীতল কণা গায়ে লাগলে জ্বরে কাঁপুনি ধরে যায়, এত বড় দামড়া ছেলে হওয়া সত্বেও। সেই জ্বর এতটা ভয়াবহ হয় যে শরীর বলকানো পানির মতো ফুটে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ণে গরম যেমন বাড়ে, সেভাবেই তাপমাত্রা বাড়ছিলো হু হু করে। নর্থ পোল – সাউথ পোলে তাপদাহ গরমে বরফ গলে যেমন পানি হয় তেমনই ওর নাক দিয়েও গলগলিয়ে পানি পড়ছিলো ফোয়ারার মতো করে। আজ মোটামুটি তবুও ভালো অবস্থায় আছে।
একটু আগে মজিদা আদা চা স্টাডি রুমে দিয়ে গিয়েছে। বাবা বাসায় নেই, কলেজে গিয়েছে ক্লাস করাতে। আসবে দুপুরের পর। সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া ভাই শান্তনুও স্কুল শেষে কোনো পাড়ায় ক্রিকেট নিয়ে মেতে আছে। সেলিনা এলেন ইতিমধ্যে৷ অভীর মা, বয়স দেখে চট করে বোঝা যাবে না উনার এত বড় বিবাহযোগ্য এক মাত্রাতিরিক্ত নজরকাড়া ছেলে আছে। ভাব সর্বদাই নির্বিকার। যেন বাড়ির মতো ইট পাথরে গড়া। তবুও এই মাকে বড্ড ভালোবাসে অভী। সে হাসলে যেন ওর পুরো পৃথিবীতে তোলপাড় লেগে যায়৷ সেলিনা ছেলের কপালে হাত রেখে আদুরে কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ কি অবস্থা তোর? জ্বর কমেছে?’
‘ হ্যাঁ, ভালোলাগছে আগের থেকে।’
‘ এই ভালোলাগাটা কতক্ষণ থাকবে আল্লাহপাকই জানে। তুই আবার গাফলতি করিস না। খাওয়ার পর ওষুধ খেয়ে নিস। ‘
‘ আচ্ছা। ‘
‘ আর এক কাপ চা দিবো?’
‘ না মা!’
‘ আর কিছু লাগবে তোর? এভাবে হাদার মতো বসে আছিস কেন? জ্বর হলে তোর তো মাথা টাথা ঠিক থাকে না।’
‘ আরে ঠিকাছি আমি। তুমি কাজ করো তোমার কেমন?’
সেলিনা চলে গিয়েছেন। সামনের লেন দিয়ে ভেসে আসছে বাচ্চাদের টুংটাং কুচকাওয়াজ। পাখির ঝাঁকের মতো সবগুলো স্কুল থেকে ফিরছে। হাত ভর্তি আচার। খাবলে খাচ্ছে সবগুলো। অভী শেলফের দিকে এগুলো। এর ডানপাশে সব গল্প উপন্যাসের বই, বাবা পড়তেন আগে, তাও কলেজ জীবনে। চাকরিতে ঢোকার পর সেগুলো পড়ে থাকলো অবহেলিত ভাবে। কেননা অভীর কোনোকালেই পছন্দ ছিলো না গল্প উপন্যাস। হাজারো খুজেঁ বাবার বর্তমাম শেলফ থেকে একটা জটিল ধরনের থিওরিটিকাল বই বের করলো। বসলো গদিতে। পড়ে সময় কাটানো যাবে।
পরন্তু ধ্যান কাটলো বাইরে স্টিলের গেটে অনবরত কড়াঘাতের শব্দতে। ভরদুপুর। ধলু মিয়া নিশ্চই গেটের পাশে থাকা ঘরে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। অভীর ভালো লাগলো না। কিন্তু নিচে সিড়ি বেয়ে নেমে গেট খুলতেও আলসেমি লাগলো। বই বন্ধ করলো সে। আলস্য ভঙ্গিতে নিচে গেলো। মা ততক্ষণে ওদিকে চলে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পরই দেখতে পেলো অন্তুসহ ওর বাকি বন্ধুবান্ধব কে। আরও রইলো আকিব, কুনাল। জুনিয়র হলেও ওদের পরম ভক্ত। এসেই বড় গলায় সালাম দিলো। সেটা গ্রহণ করলো অভী। অন্তু, রাইতা এসে কাঁধে চাপড় মেরে বললো,
‘ কিরে কি অবস্থা, জ্বরে নাকি টিপিক্যাল বাঙালী রমনীর মতো মরে যাচ্ছিলি।’
‘ ওমন কিছুই না।’
বসতে বসতে গম্ভীর স্বরে বললো অভী। তবে খেয়াল করলো সবার চোখে মুখেই একটা চাপা হাসি। ভড়াকলো সে। বললো,
‘ কি হলো তোদের?’
‘ তোর আনারকলি কে এনেছি!’
জ্বর জ্বর মাথায় কথাটি চট করে ধরতে পারলে না অভী। তাই জিজ্ঞাসু কন্ঠে বললো,
‘ মানে?’
এবার ফোড়ন কাটলেন সেলিনা৷ বললেন,
‘ প্রিয়তা এসেছে!’
অভী শাণিত দৃষ্টিতে রাইতার পাশে গুটিশুটি হয়ে থাকা প্রিয়তাকে দেখলো। অদ্রিও আছে, রুদ্রও আছে। তবে ছেলেটার সম্পূর্ণ দৃষ্টি প্রিয়তার দিকে। অভীর শরীর নড়বড়ে হয়ে উঠলো। নিঃশ্বাস হয়ে এলো ঘন। জ্বরের প্রকোপে কিনা জানেনা তবে প্রিয়তাকে এখানে ভাবাটা ছিলো ওর কল্পনার বাইরে। অবচেতন মন অজান্তেই প্রিয়তার মতো হয়ে এলো অসাড়। ঘামছে সে। প্রিয়তার দৃষ্টি বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে সেও জ্ঞান হারাবে। কি ব্যাপার? অভীকেও কি প্রিয়তার মতো সেন্সলেস ভাইরাস চেপে ধরলো?
.
.
.
.
.
.
.
.
#চলবে