প্রিয়তা একবার নিজের জামার খোলা চেইন দেখলো আর একবার দেখলো সামনে শুধু ট্রাউজার পড়া অভীর দিকে। অল্প মুহূর্তে চট করেই সে বুঝে ফেললো পরিস্থিতিটা। হাতে থাকা শাড়ির ভাঁজ খুলে নিচে পড়ে গেলো । কোনোমতে জামার চেইন লাগিয়ে চিৎকার দিতে যাবে সাথে সাথেই অদূরে দাঁড়ানো মানুষটা ঝড়ের গতিতে এসে পড়লো প্রিয়তার কাছে। দুরত্ব ঘুচালো। প্রিয়তাকে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো আতঙ্কে। এছাড়া উপায় নেই। নাহলে এই মেয়ে যা, চিল্লিয়ে পাড়া সুদ্ধ সবার কাছে ব্যাপারটা সম্প্রচার করে বেড়াবে।
প্রিয়তার বুক ধক করে উঠলো। অভীকে এত কাছে পেয়ে আরও একদফা জ্ঞান হারাবার উপক্রম হলো। অভীর গায়ে চিকচিক করছে মুক্তাদানার মতো পানি। চুলে ভেজা। সেখান থেকে সুরসুর করে শ্যাম্পুর ঘ্রাণ বেরোচ্ছে। মাথা ধরে যাচ্ছে এই সুগন্ধে। ডানপিটে বলিষ্ঠ এই শরীরের চাপে প্রিয়তা যেন হিতাহিতজ্ঞান হারালো। অভী তা দেখে বলে উঠলো,
‘ খবরদার প্রিয়তা উল্টাপাল্টা কোনো অঘটন ঘটাবে না। এটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্টে। ক্লিয়ার? এখন শান্ত হও।’
বলেই চট করে দূরে সরে এলো অভী। প্রিয়তা নিঃশ্বাস ফেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ক্রমাগত। অভীর দিকে তাকানোর শক্তি তার নেই। ছেলেটার শরীরের গড়ন ভয়ংকর, ভার্সিটিতে চেক শার্ট আর ডেনিমের ভীড়ে অভীর গায়ের এমন আকর্ষণীয় গঠন বোঝা দুষ্কর। প্রিয়তা ঠোঁট ভেজালো। শাণিত কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
‘ আপনি আমার…আমার রুমে কি করছেন?’
বিরক্ত হলো অভী। ভেজা গা, টাওয়েল দেখে বুঝতে পারছে না বোকা মেয়েটা? অভী দাঁতো দাঁত চেপে বললো,
‘ খালি গায়ে ক্রিকেট খেলছি। আমার অ্যাম্পায়ার হবে নাকি?’
প্রিয়তা ভীমড়ি খেলো। ধরতে পারলো না অভীর অনির্দেশক কথা। বলে উঠলো,
‘ এটা কি ক্রিকেট খেলার জায়গা?’
অভী হাল ছাড়লো। নাহ! এই মেয়ে তার মাথা ঘুরিয়ে ফেলবে। নিঃশ্বাস ফেললো অভী। ঘন কালো চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে তা ঠেলে দিলো পেছনে। বললো,
‘ আল্লাহর ওয়াস্তে তোমার ভাই রুদ্রিক কে পাঠাও। ছেলেটা আমায় শুধু ট্রাউজার দিয়েই সটকে পড়েছে। এখন শুধু ট্রাউজার পড়েই বাইরে বেরোবো নাকি?’
রুদ্রের ভালো নাম রুদ্রিক। তবে পরিবারের সবাই ওকে রুদ্র নামেই ডাকে। অভীর হঠাৎ এ নামে সম্বোধন করাতে প্রিয়তা যেন ভুলে গিয়েছিলো রুদ্রের সার্টিফাইড নাম। অতঃপর বললো,
‘ কেন আপনার জামা কই?’
প্রিয়তা ফট করে মুখ চেপে ধরলো এবার। হায় আল্লাহ! সে তো এত বোকা না। তাহলে অভীর সামনে এমন বোকা বনে গিয়েছে কেন সে? অভী কিড়মিড়িয়ে বললো,
‘ আমার শার্ট আর প্যান্ট কি তুমি পড়ার অবস্থায় রেখেছো?’
প্রিয়তা কথা বললো না। তাকালোও না অভীর দিকে। এর দিকে মোটেও তাকানো যাবে না। নাইলে অদ্রির মতো ভয়াবহ কয়েকটা বেফাঁস কথা বলে ফেলার সম্ভাবনা আছে। তবে মনে মনে প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছে সে। এই কারনে, ঠিক এই কারনেই অভীকে তার পছন্দ না। ছেলেটা চরম ইগোস্টিক। ভাব তো এমন যে মেয়েদের সাথে কথা বলাই পাপ। প্রিয়তা নিজেকে ধাতস্থ করলো। বলে উঠলো,
‘ আপনি, আপনি থাকুন। আমি রুদ্রকে নিয়ে আসছি।’
বলেই তড়িঘড়ি করে দরজা খুলেই স্তব্ধ হলো প্রিয়তা। অদ্রি দাঁড়িয়ে আছে। কোলে তুশি রুশি। হ্যাংলা পাতলা দুটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আসতে অদ্রির তেমন অসুবিধা হলো না। তবে সে এখন চরম বিস্ময়ে আছে। মাথা বাকিয়ে বোয়াল মাছের মতো হা করে দেখে নিলো অভীর আগুন রূপ। তারপর চেচিয়ে বলে উঠলো,
‘ ওএমজি, অভী ভাইয়া হাফ নেকেড হয়ে তোর রুমে কি করছে প্রিয়ু?’
প্রিয়তা বিষম খেলো। অস্থির হয়ে ইশারায় চুপ করতে বললো অদ্রিকে। তুশি রুশির দিকে তাকালে বোঝা যাবে যে ওরা কিছুই বোঝেনি। তবুও ওরা আদরের অদি আপুর মতো ভনিতা করে প্রিয়তাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ হাফ নেকেড হয়ে তোমার রুমে কি করছে হুম..হুম?’
অথচ এই দুটো পিচ্চি এখনও জানে না এর বাংলা অর্থ কি। অভী প্রিয়তাকে ইশারায় বললো অদ্রিকে নিয়ে ভেতরে আসতে। প্রিয়তা সাথে সাথে তাই করলো। অভীর মুখ ভার। চোখের শীতল দৃষ্টি দেখে বোঝা যাচ্ছে না যে তার মনে কি চলছে। রুদ্রিকও ইতিমধ্যে এসে পড়েছে পোলো শার্ট নিয়ে। সেটা অভী গায়ে গলিয়ে দিলো। তারপর নিখাদ কন্ঠে বললো,
‘ ট্রাস্ট মি রুদ্রিক আজ যদি এ বাড়িতে এজ এ তোমার ভার্সিটির সিনিয়র ভাইয়া হয়ে আসতাম কষিয়ে দুটা চড় মারতাম।’
রুদ্র ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। সে রীতিমতো ভুলে গিয়েছিলো অভীর কথা যে সে প্রিয়তার রুমে আছে। এমনিতেও অভীকে রুদ্র ভয় পায়, একটু না, বাড়াবাড়ি রকমেরই ভয় পায়। ইউনিভার্সিটিতে কোনো ইভেন্ট চলাকালীন সময় প্রায়ই রুদ্রকে কাজ করতে হয়েছে অভীসহ আরও বেশ কয়েকজন সিনিয়র স্টুডেন্টদের সাথে। তারপর থেকেই অভীর গম্ভীরতা, প্রগাঢ় দৃষ্টি আর একরোখা টাইপ ব্যবহারের জন্য রুদ্র,অদ্রি,প্রিয়তার মতো আরও অনেক ডানপিটে স্বভাবের ছাত্রছাত্রীরাই ছিলো অতিষ্ঠ।
অভী উঠে দাঁড়ালো। চোখ বুলিয়ে নিলো প্রিয়তার ঘরে। মেয়েটা ভীষণ বই পড়ুয়া। এটা অবশ্য আগে থেকেই জানে। সেই সাথে একটু অস্থির ধরনের মেয়ে। যদিও অভীর সাথে বিয়ের ব্যাপার এগোনোর পর থেকে মেয়েটাকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বোকা খেতাবি দিতে ইচ্ছে করছে। তুশি রুশি চকলেট খাচ্ছিলো। হুট করে অভীকে প্রশ্ন ছুড়লো,
‘ তুমি এতক্ষণ কি করছিলে এখানে?’
প্রিয়তা সচকিত হয়ে তাকালো ওদের দিকে। এতক্ষণে অভীর ঠোঁটে ফুটলো হাসি। খুব সুক্ষ্ণ একধরনের হাসি। বলে উঠলো,
‘ তোমার প্রিয়ু আপুর সাথে ক্রিকেট ক্রিকেট খেলছিলাম।’
বিষম খেলো রুদ্র,অদ্রি। অকপটে চাইলো দুজনে প্রিয়তার দিকে। বলে উঠলো,
‘ শালী এই না ঢং দেখালি যে বিয়ে করবিনা, আর এখন বিয়ের আগেই ক্রিকেট-ফুটবল সব খেলা শেষ? আমিও তো বলি যে তুই আর ভাইয়া এক ঘরে কি করছিলি। হায় খোদা! তুই এতবড় ধোকাবাঁজ হতে পারলি? আমায় না বলে কয়ে সত্যিই তার সাথে ক্রিকেট খেললি?’
প্রিয়তা আড়চোখে দেখলো অভীর চোখে মুখে দুর্বোধ এক হাসি। যেন ইচ্ছে করেই অদ্রির সামনে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এরই মধ্যে কান্না জুড়ে দিলো তুশি রুশি। বলে উঠলো,
‘ জানো রুদ্র ভাইয়া যখন পাড়ায় ক্রিকেট খেলতে চায় তখন আমাদের নেয়না। আমিও ক্রিকেট খেলতে চাই ভাইয়া।’
রুদ্র কোলে নিলো ওদের। বলে উঠলো,
‘ এই ক্রিকেট সেই ক্রিকেট না রে বইন। এই ক্রিকেট বেড রুমে খেলতে হয়। তোরা যেদিন বড় হবি, নিজেদের বেডরুম হবে, তখন ক্রিকেট, ফুটবল, কাবাডি সব খেলিস।’
দুজনেই বোকা বোকা চোখে দৃষ্টিপাত করলো তাদের ভাইয়ার দিকে। প্রিয়তার মুখ হা। কি শুরু করেছে এরা। অভীর প্রতি ভয়ঙ্কর রাগ উঠছে প্রিয়তার। ছেলেটা ইচ্ছে করেই তাকে ফাসিয়েছে। এই শোধ সে নিয়েই ছাড়বে।
____________
পায়েস খাচ্ছে অভী। সামনে হা করে তাকে দেখছে অদ্রি আর প্রিয়তা। অভী নাস্তানাবুদ হলো। সায়রা বানু এক মুহূর্তের জন্য এখান থেকে চলে যেতেই সে শীতল কন্ঠে বললো,
‘ এমন বোয়াল মাছের মতো আমায় দেখছো কেনো অদ্রি?’
‘ হবু দুলাভাইকে দেখতে দোষ নেই ভাইয়া। প্রিয়তা মরে গেলেও এমন করে বিয়ের আগে আপনাকে দেখবে না। তাই শালী হিসেবে আমারই তো উচিত সেই দায়িত্ব পালন করা। তাইনা?’
প্রিয়তা চিমটি দিলো অদ্রির উরুতে। বললো,
‘ আল্লাহর ওয়াস্তে ১০ মিনিটের জন্য তোর লু’চ্চা’মি অফ কর।’
অদ্রি পরোয়া করলো না। সায়রা বানু এসে প্রশ্ন করলেন,
‘ পায়েস টা তোমার কেমন লাগলো অভী বাবা?’
‘ ভালো হয়েছে।’
‘ আচ্ছা শোনো, আজ তো কথা ছিলো প্রিয়তাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে। কাল নাহয় যেও? সারাদিন ঘুরবে, একে অন্যকে টাইম দিবে। তাহলেই তো ব্যাপারটা এগোবে।’
প্রিয়তার মনে একটু ক্ষীণ আশা ছিলো হয়তো না বলবে। তবে ওকে অবাক করে দিয়ে রাজি হয়ে গেলো অভী। একপলক প্রিয়তার মুখ দেখে ক্ষীণ হাসি দিলো। প্রিয়তার কাছে মতিগতি ভালো লাগছে না অভীর। এই ছেলে মনেমনে ভয়ঙ্কর কিছু পরিকল্পনা করেছে।
অভী যাওয়ার অনিতপূর্বেই আস্তে করে কেটে পড়তে চাইলো প্রিয়তা। কিন্তু ওর ভাগ্যটা বড্ড খারাপ। এতগুলো অঘটনের পরও খোদা ওর ওপর রহম করলো না। অভী যাওয়ার পূর্বে সবার চক্ষুগোচরে হাতছানি দিলো প্রিয়তার। দুরত্ব ঘোচালো। এতদিন মুখ গম্ভীর থাকলেও এখন ঠোঁটে নিষ্ঠুর হাসি। বলে উঠলো,
‘ আজকে বেডরুমে তোমায় ওই অবস্থায় দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম প্রিয়তা। নেক্সট টাইম এমন কাজ করবে না। ভুলেও করবে না। বিয়ের পর এমন কোনো কান্ড বাঁধালে সাথে সাথে আছাঁড় মারবো তাহলে। আর হ্যাঁ, বেশি করে প্রোটিন খাও। এখন অজ্ঞান হওয়া টওয়া চলবে না। সামনের পরিস্থিতি গুলোতে তোমায় সটান হয়ে থাকতে হবে। সি ইউ টুমোরো মিস তাহমিনা প্রিয়তা। উইশ ইউ অল দ্যা বেস্ট!’
বলেই বাইরে পা বাড়ালো অভী। প্রিয়তা থমকে রইলো। ভুলে গেলো হিতাহিত পরিবেশ। কি বললো এসব অভী? এতকিছুর পরও সে কি সত্যি সত্যি বিয়ে করবে প্রিয়তাকে। অদ্রি পেছনে সবই শুনেছিলো। প্রিয়তার কাছে এসে বেপোরোয়া সুরে বললো,
‘ তোর চু’মুর পাওয়ারে পাল্টি খেয়েছে বস! কেন জানি মনে হচ্ছে তোর বিয়ে অভী ভাইয়ার সাথেই হবে।’
ছলছল নয়নে হাসিমাখা বদন নিয়ে প্রিয়তার গ্লানি চোখজোড়া অদ্রিকে বিভৎসভাবে উপহাস করলো। মনে মনে সে বলে উঠলো,
‘ তোরা সবক’টা শয়তান। কাল আমিও ওই অভী ব্যাটাকে দেখাবো প্রিয়তার সাথে ঝামেলা করার মজা!’
.
.
.
.
.
#চলবে